About Us Contact Us Privacy Policy Terms & Conditions Copyright

চুইঝালের চাষ পদ্ধতি। চুইঝালের ব্যবহার, বাজারমূল্য ও সম্ভাবনা

Please don't forget to share this article

চুইঝাল বাংলাদেশের একটি অপ্রচলিত মশলা জাতীয় ফসল। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিশেষ করে খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, সাতক্ষীরা, যশোর, নড়াইল, বরিশাল,ফরিদপুর এসব জেলার চাষিদের কাছে এটি একটি অর্থকরী মশলা ফসল। পিপারাসি পরিবারের সপুষ্পক লতা চুই। এর বৈজ্ঞানিক নাম Piper chaba। এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থানীয় প্রজাতি। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিশেষ করে খুলনা, যশোর, বাগেরহাট, সাতক্ষীরায় চুইঝাল বেশ জনপ্রিয় এবং দেশের বেশির ভাগ চুইঝাল সেখানেই উৎপাদন হয়। অন্য গাছের সাথে আশ্রয় নিয়ে এরা বেড়ে উঠে। তাছাড়া মাটিতে লতানো ফসল হিসেবেও বেড়ে উঠতে পারে। মোটামুটি সব গাছের সাথেই বাড়ে। তবে আম, কাঁঠাল, মেহগনি, সুপারি, শিমুল, নারিকেল, মেহগনি, গাছে ভালো হয়। আবার আম, শিমুল, কাফলা ও কাঁঠাল গাছে বেড়ে ওঠা চুই সবচেয়ে ভালোমানের হয়।

চুই গাছের পরিচিতিঃ

চুই লতা জাতীয় অর্থকরী ফসল। এর কাণ্ড ধূসর এবং পাতা পান পাতার মতো সবুজ রঙের। এর কাণ্ড, শিকড়, শাখা, প্রশাখা সবই মসলা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। চুই সাধারণত দুই প্রকার। একটির কাণ্ড আকারে বেশ মোটা ২০ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার, অন্যটির কাণ্ড চিকন, আকারে ২.৫ থেকে ৫ সেন্টিমিটার। চুই পাতা ২ থেকে ৩ ইঞ্চি লম্বা হয়। চুইপাতা দেখতে অনেকটা গোলমরিচ পাতা বা পানপাতার মতো হয়ে থাকে। চুই গাছ ১০ থেকে ১৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। গাছ দীর্ঘদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকে।

চুইয়ের ব্যবহারঃ

  • বড় বড় মাছ বা যে কোনো মাংসের সাথে চুইয়ের কাণ্ড খাওয়া যায়।
  • আঁশযুক্ত নরম কাণ্ডের স্বাদ ঝালযুক্ত। লতার পর্বমধ্য ছোটোছোটো করে কেটে টুকরো করে তরকারি, ডালসহ অন্যান্য ঝালযুক্ত উপকরণ হিসেবে রান্নার কাজে ব্যবহৃত হয়।
  • ছোলা, ভাজি, আচার, হালিম, চটপটি, ঝালমুড়ি, চপ ও ভর্তা তৈরিতে চুইঝাল ব্যবহৃত হয়।
  • চুইয়ের কাঁচা কাণ্ড অনেকে লবণ দিয়ে বা চিবিয়ে খান। চুইয়ের লতাকে শুকিয়ে গুঁড়া করেও দীর্ঘদিন রাখা যায় পরবর্তীতে ব্যবহারের জন্য।
  • এক কথায় মরিচ, গোলমরিচ ঝালের বিকল্প হিসেবে যে কোনো কাজে চুইঝাল ব্যবহার করা যায়।

চুইঝালের ফুল, ফল ও পরাগায়নঃ
চুইঝালের পুরুষ ও স্ত্রী ফুল আলাদা লতায় জন্মে। পরাগায়ন প্রাকৃতিকভাবেই সম্পন্ন হয়। ফুল লাল লম্বাটে দূর থেকে দেখতে অনেকটা মরিচের মতো। ফলের ব্যাস ১ ইঞ্চির মতো। ফল সাধারণত লাল রঙের হয়। তবে পরিপক্ব হলে বাদামি বা কলো রঙের হয়ে যায়। বর্ষায় ফুল আসে, শীতের শুরুতে ফল আসে।

জমি ও মাটিঃ দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি এবং পানি নিষ্কাশনের সুবিধাযুক্ত ও ছায়াময় উঁচু জমিতে সাধারণত চুই চাষ করা হয়। সাধারণ ফলবাগান বা বৃক্ষ বাগানের মাটি চুই চাষের জন্য উপযোগী।

রোপণের সময়ঃ বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ (এপ্রিল-মে) এবং আশ্বিন-কার্তিক (অক্টোবর-নভেম্বর) মাস এ দুইবার হলো চুইঝালের লতা রোপণের উপযুক্ত সময়।

বংশবিস্তারঃ
বীজ ও অঙ্গজ প্রজনন বা লতা কাটিং পদ্ধতিতে চুইঝালের বংশবিস্তার করা যায়। কাটিং পদ্ধতিতে এর কাণ্ড বা শাখা ৫০ থেকে ৭৫ সেমি লম্বা করে কেটে সরাসরি মাটিতে রোপণ করা হয়। স্থানীয়ভাবে কাটিং বা শাখাকে পোড় বলা হয়। একটি পোড়ে কমপক্ষে ৪/৫ টি পর্বসন্ধি থাকে। বাণ্যিজিকভাবে পলিব্যাগে চারা তৈরি করা যায়। পরে পলিব্যাগ থেকে চারা নিয়ে মূল জমিতে রোপণ করা যায়। লতা কাটিংয়ে গাছ দ্রুত বড় হয় এবং ফলন তাড়াতাড়ি পাওয়া যায়। বীজ থেকে বংশবিস্তার জটিল, সময়সাপেক্ষ বলে আমাদের দেশে শুধু লতা থেকে বংশবিস্তার করা হয়।

কাটিং শোধনঃ
চুইঝালের কাটিং চারা রোপণের আগে অবশ্যই শোধন করে নেওয়া ভালো। ১ লিটার পানিতে ২-৩ গ্রাম প্রোভ্যাক্স/নোইন/অটোস্টিন মিশিয়ে কাটিং ৩০ মিনিট চুবিয়ে রাখার পর পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলে কাটিং রোপণ করতে হবে। ফলে পরবর্তীতে রোগ ও পোকার আক্রমণ কম হয়।

সার ও সেচ ব্যবস্থাপনাঃ চুই চাষে চাষিরা সাধারণত পোড় বা শাখা রোপণের পূর্বে গর্তে পচা আবর্জনা বা ছাই ব্যবহার করেন। তাছাড়া কৃষি বিভাগের পরামর্শ অনুযায়ী সাধারণ হারে ইউরিইয়া, টিএসপি, এমওপি বর্ষার আগে ও পরে গাছের গোড়া থেকে ১ হাত দূরে প্রয়োগ করে থাকেন। সপ্তাহে ১ বার গাছের গোড়ায় সেচ দিলে গাছের বাড়বাড়তি স্বাভাবিক থাকে। বর্ষাকালে চুইঝালের গোড়ায় যাতে পানি না জমে সে দিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে।

চুইঝাল গাছ লাগানোর পদ্ধতিঃ সাধারণত আম, সুপারিসহ কাঠ জাতীয় গাছের গোড়া থেকে ১২-১৫ ইঞ্চি দূরে গর্ত করে চুই গাছের কাটিং লাগাতে হয়। গর্তের মধ্যে কিছু গোবর, বর্জ্য, ৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ৫০ গ্রাম টি এস পি, ৫০ গ্রাম পটাশ দিয়ে গর্তে ও মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে ৭ দিন রেখে কাটিং লাগাতে হবে। গর্তে একটি খুঁটি কাত করে বড় গাছের সাথে বেঁধে দিলে ৩০-৪০ দিনের মাঝে তা গাছের কাণ্ডের সাহায্যে উপরে উঠে যাবে। এভাবে চুই গাছ বাড়তে থাকবে।

বাউনি দেওয়াঃ চুইঝাল যেহেতু লতা জাতীয় তাই এর জন্য আরোহণের অন্য গাছের সাপোর্ট লাগে। আম, জাম, সুপারি, নারিকেল ও কাফলা গাছ বাউনি হিসেবে চুই চাষের জন্য ব্যবহৃত হয়। বাউনি না দিলেও মাটিতে বৃদ্ধি পায়। তবে এক্ষেত্রে বর্ষা মৌসুমে গাছের ক্ষতি হয়। কৃষকদের মতে আম ও কাফলা গাছে চাষকৃত চুই খুব সুস্বাদু হয়।

ফসল সংগ্রহঃ চুই রোপণের ১ বছরের মাথায় খাওয়ার উপযোগী হয়। তবে ভাল ফলনের জন্য ৫/৬ বছরের গাছই উত্তম।

ফলনঃ হেক্টর প্রতি প্রায় ২.০ থেকে ২.৫ মেঃ টন ফলন পাওয়া যায়। ৫/৬ বছরের একটি গাছ থেকে প্রায় ১৫ থেকে ২৫ কেজি পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়।

চুইঝালের বাজারমুল্যঃ শুকনো এবং কাঁচা উভয় অবস্থায় চুইঝাল বিক্রি হয়। বর্তমানে প্রতি কেজি কাঁচা চুইঝাল লতা অঞ্চল ভেদে ৬০০ থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। তবে শাখা ডাল থেকে শিকড়ের ডালে ঝাল বেশি হয় বলে এর দামও একটু বেশি। শুকনো চুইয়ের দাম কাঁচার চেয়ে আরও ২-৩ গুণ বেশি। অর্থাৎ ১৫০০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। আবার সাতক্ষীরাতে কোথাও কোথাও প্রতিকেজি চুই ঝাল ৩০০ থেকে ৬০০ টাকাতেও  বিক্রি হয়ে থাকে। মাত্র ২-৪ টি চুই গাছের চাষ করে নিজের পরিবারের চাহিদা মিটানো সম্ভব।

চুইঝালের ঔষধিগুণঃ

  • খাবারের রুচি বাড়াতে এবং ক্ষুধামন্দা দূর করতে কার্যকর ভূমিকা রাখে;
  • পাকস্থলী ও অন্ত্রের প্রদাহ সারাতে চুইঝাল অনেক উপকারী;
  • গ্যাস্ট্রিক সমস্যার সমাধান করে ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে;
  • স্নায়ুবিক উত্তেজনা ও মানসিক অস্থিরতা প্রশমন করে;
  • ঘুমের ওষুধ হিসেবে কাজ করে এবং শারীরিক দুর্বলতা কাটাতে এবং শরীরের ব্যথা সারায়;
  • শারীরিক দুর্বলতা কাটাতে অথবা শরীরের ব্যথা সারাতে পারে চুই ঝাল সহায়তা করে;
  • হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, কাশি, কফ, ডায়রিয়া, রক্তস্বল্পতা, দূর করে;
  • এক ইঞ্চি পরিমাণ চুই লতার সাথে আদা পিষে খেলে সর্দি সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

চুইঝালের চারা প্রাপ্তিস্থানঃ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় সব নার্সারিতে চুইঝালের চারা পাওয়া যায়। তবে খুলনা জেলায় ‘ অশোক নার্সারি’ তে প্রতি পিস চুই ঝালের চারা নার্সারি মালিক অশোক বৈরাগী ৩০/৪০ টাকা পাইকারী দরে বিক্রি করেন। এ পর্যন্ত যশোর, ঢাকা, সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, বরিশাল, ফরিদপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে তার কাছ থেকে চুই ঝালের চারা কিনেছেন সেখানকার কৃষি বিভাগ এবং ব্যবসায়ীরা।

সরকারিভাবে উদ্যোগ নিলে বাংলাদেশে মরিচের বদলে চুইয়ের চাষের বিস্তার ঘটিয়ে প্রতি বছর চুইঝাল বিদেশে রপ্তানি করে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।

 

 

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

As you found this post useful...

Follow us on social media!

We are sorry that this post was not useful for you!

Let us improve this post!

Please don't forget to share this article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি। সকল স্বত্ব www.agriculturelearning.com কর্তৃক সংরক্ষিত