About Us Contact Us Privacy Policy Terms & Conditions Copyright

কাসাভা একটি সম্ভাবনাময় আলুজাতীয় ফসল।কাসাভার চাষ পদ্ধতি

Please don't forget to share this article

কাসাভা (Cassava) হলো উষ্ণমন্ডলীয় অঞ্চলের আলুজাতীয় ফসল যা পৃথিবীর প্রায় ২০০ মিলিয়ন মানুষের খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এটি আফ্রিকা মহাদেশের বেশির ভাগ মানুষের প্রধান খাবার। কাসাভা বর্তমানে বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে। গ্রামের মানুষ কাসাভার কন্দকে ‘শিমুল আলু’ বলে। গাছটির পাতা অনেকটা শিমুল গাছের মতো দেখতে বলেই হয়তো এরকম নামকরণ।

কাসাভার জাত: কাসাভার অনেকগুলো প্রচলিত ও উন্নত জাত রয়েছে। কৃষকরা খাবার ও বানিজ্যিক উদ্দ্যেশ্যের ভিত্তিতে জাত নির্বাচন করে থাকে । খাবারের জন্য অনেক অঞ্চলে মিষ্টি জাতের কাসাভা চাষ করা হয় । ভারতে কাসাভার জনপ্রিয় হাইব্রিড জাতগুলো হলো M-4, H-97, H-165,H-226, H-1687, H-2304 I S-856। ইন্দোনেশিয়ায় ADIRA-1,2,3,4 থাইল্যান্ডে RAYONG-1,2,3,60 ফিলিপাইনে PR-C 13,24,62 এবং চীনে SC-201,205,124জাতগুলো জনপ্রিয় । নাইজেরিয়ায় TMS-3001,30572,50395,30555এবং কলম্বিয়ায় M.Col.-2215,1684, M.BRA-5,12 জাতগুলো উল্লেখযোগ্য।

কাসাভার পুষ্টিগুণঃ কাসাভায় সাধারনভাবে ৩০-৪০ ভাগ শর্করা , ১-২ ভাগ প্রোটিন, এবং ৫৫-৬০ ভাগ জলীয় অংশ বিদ্যমান । আলুর তুলনায় কাসাভাতে দ্বিগুনেরও বেশী শর্করা থাকায় ইহা আলুর চেয়ে আনেক বেশী পুষ্টিকর । যেখানে আলুতে ১৮ ভাগ শর্করার মাত্র ১৬.৩ ভাগ স্টার্চ হিসাবে থাকে সেখানে কাসাভার ৪০ ভাগ শর্করার ৯০ ভাগই স্টার্চ হিসাবে থাকে । এছাড়াও কাসাভাতে ক্রুড ফাইবার, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন ও ভিটামিন সি উল্লেখযোগ্য পরিমানে পাওয়া যায়।

কাসাভার রোগ প্রতিরোধ গুনাগুণঃ কাসাভার আঠালো অংশ ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ উপশমের ক্ষেত্রে কাজ করে। কাসাভা ফাইবার বাড়তি কোলেস্টরলের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করে। এমনকি এটি ক্যান্সার প্রতিরোধেও ভূমিকা রাখে।

কাসাভা বিশ্বজুড়ে কোথায় চাষ হয়ঃ পৃথিবীর উৎপন্ন কাসাভার ৬০ ভাগ মানুষের খাদ্য, ২৫ ভাগ পশুখাদ্য এবং বাকিটা স্টার্চ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। আফ্রিকায় ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় এ ফসল মানুষের খাবারের অন্যতম প্রধান উপাদান। দক্ষিণ আমেরিকায় মানুষের পাশাপাশি গবাদিপশুর খাদ্য হিসেবেও কাসাভা ব্যবহৃত হয়। আফ্রিকার নাইজেরিয়া, উগান্ডা, তানজানিয়া, মোজাম্বিক, ঘানা ও জায়ারে সবচেয়ে বেশি কাসাভা চাষ হয়। এশিয়ায় চীন, ভারত, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও ভারতে কাসাভার চাষ হয়। এসব জায়গায় মানুষের খাবারের পাশাপাশি স্টার্চ কারখানার কাঁচামাল হিসেবে কাসাভার ব্যবহার বেশি লক্ষ্য করা যায়।

কাসাভার উৎপত্তির ইতিহাসঃ প্রায় ৭ হাজার বছর আগে কলম্বিয়া ও ভেনিজুয়েলায় কাসাভা চাষের ইতিহাস জানা যায়। তাই দক্ষিণ আমেরিকাকেই কাসাভার উৎপত্তিস্থল হিসেবে মনে করা হয়। পনের শতকে স্প্যানিশ বসতি স্থাপনকারীদের দ্বারা মধ্য আমেরিকায় এর চাষ সম্প্রসারিত হয়। ষোল শতকের শেষের দিকে পর্তুগিজরা কাসাভা আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলে নিয়ে আসে। এশিয়ায় প্রথম ফিলিপাইনে স্প্যানিশরা মেক্সিকো থেকে কাসাভা নিয়ে আসে, যা পরে অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। আঠারো শতকের শুরুতে পর্তুগিজদের দ্বারা ভারতে কাসাভার আগমন ঘটে। জানা যায়, বাংলাদেশে উনিশ শতকের মাঝামাঝি জনৈক খ্রিস্টান মিশনারির মাধ্যমে মধুপুর অঞ্চলে প্রথম কাসাভা চাষ করা হয়।

কাসাভা চাষ পদ্ধতিঃ উষ্ণ ও নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল কাসাভা চাষের উপযোগী। অনুর্বর পাহাড়ি মাটি কিংবা বালিমাটি যেখানে অন্য কোনো ফসল ফলানো যায় না সেখানেও কাসাভা চাষ করা যায়। তবে এ ফসল জলাবদ্ধতা ও উচ্চ লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে না।

জলবায়ুঃ এটি একটি খরাসহনশীল ফসল। যেখানে ছয় মাস পর্যন্ত খরা বা শুষ্ক অবস্থা বিরাজ করে সেখানেও কাসাভা সহজে চাষ করা যায়। তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে কাসাভা ভালো হয় না। উপযুক্ত তাপমাত্রা ২৫-৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার ৩০০ মিটার ওপরেও কাসাভা চাষ করা যায়।

বংশবিস্তারঃ গাছ লাগানোর জন্য বীজ কিংবা কাটিং উভয়ই ব্যবহার করা যায়। বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য পরিপক্ব কাণ্ডের কাটিং ব্যবহার করা হয়। কাসাভা সংগ্রহের সময় সুস্থ, সবল ও রোগমুক্ত কাণ্ডগুলো কেটে পরবর্তী বছর লাগানোর জন্য ছায়াযুক্ত স্থানে সংরক্ষণ করতে হয়। লাগানোর সময় কা-কে ১৫-২০ সেমি করে কেটে সোজা করে লাগাতে হবে। প্রতিটি কাটিংয়ে কমপক্ষে ৫ থেকে ৭টি নোড থাকতে হবে।

জমি তৈরিঃ সাধারণত জমিতে চাষের প্রয়োজন হয় না। তবে বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য জমি চাষ করা যেতে পারে। অধিকাংশ জায়গায় পিট তৈরি করে কাসাভার কাটিং বা সেট লাগানো হয়। পাহাড়ি এলাকায় এটি একটি সহজ ও সুবিধাজনক পদ্ধতি। তবে পিটগুলো মাটি থেকে একটু ওপরের দিকে উঠানো হলে ফলন ভালো পাওয়া যায়।

গাছ লাগানোর নিয়মঃ প্রতি হেক্টর জমিতে ১০ হাজার গাছ লাগানো যায়। একটি গাছ থেকে অন্য গাছের দূরত্ব ৭৫ থেকে ৯০ সেমি রাখতে হবে। কাটিং মাটিতে লাগানোর সময় ২০ সেমি মাটির নিচে এবং ৫ সেমি মাটির ওপরে থাকতে হবে। সাধারণত ১৫-২০ দিনের মধ্যে কাটিং থেকে নতুন কুশি বের হয়। যেসব কাটিং থেকে কুশি বের হবে না সেগুলো তুলে ফেলে সেখানে ৪০ সেমি আকারের নতুন কাটিং লাগাতে হবে।

গাছ লাগানোর সময়ঃ সারা বছরই গাছ লাগানো যায়। তবে সাধারণত বর্ষার শুরুতে কাসাভার কাটিং লাগানো ভালো। আমাদের দেশে এপ্রিল-মে মাস কাসাভা লাগানোর সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।

সার ব্যবস্থাপনাঃ তেমন কোনো সার প্রয়োগ করতে হয় না। তবে বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য হেক্টরপ্রতি ১৮০-২০০ কেজি নাইট্রোজেন, ১৫-২২ কেজি ফসফরাস ও ১৪০-১৬০ কেজি পটাসিয়াম প্রয়োগ করলে সর্বাধিক ফলন পাওয়া যায়।

সেচঃ সাধারণত সেচের প্রয়োজন হয় না। তবে কাটিং লাগানোর পর গাছ গজানোর জন্য ৩-৫ দিন অন্তর কমপক্ষে দুবার সেচ দিতে হবে। দীর্ঘদিন খরা অবস্থা বিরাজ করলে হালকা সেচের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে ফলন বৃদ্ধি পায়।

আন্তঃপরিচর্যাঃ গাছ লাগানোর পর ১ মাস অন্তর গোড়ার আগাছা পরিষ্কার করে গোড়ায় মাটি তুলে দিলে ফলন ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। যদিও কাসাভায় রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ খুবই কম তথাপিও এক ধরনের মাকড়ের আক্রমণে অনেক সময় ফসলের ক্ষতি হয়। সব সময় রোগবালাই ও পোকামাকড় মুক্ত কাটিং লাগাতে হবে এবং মাকড়ের আক্রমণ থেকে ফসলকে রক্ষা করতে হলে আক্রমণ দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাকড়নাশক স্প্রে করতে হবে। অনেক সময় ইঁদুর মাটির নিচের কাসাভা খেয়ে বেশ ক্ষতি করে। এ জন্য বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ ও বিষটোপ ব্যবহার করে ইঁদুর দমন করতে হবে।

কাসাভার সাথে আন্তঃফসল চাষঃ আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার ৯০ ভাগ কাসাভা জমিতে আন্তঃফসল হিসেবে ডালজাতীয় ফসল ও শাকসবজি চাষ করা হয়। ভারতে কাসাভার সঙ্গে আন্তঃফসল হিসেবে শিম, চীনাবাদাম, মটর, পেঁয়াজ ও শাকসবজি চাষ করা হয়। ইন্দোনেশিয়ায় কাসাভার সঙ্গে ধান ও ভুট্টা চাষ করা হয়। মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ডে নারকেল, পাম অয়েল ও রাবার বাগানে আন্তঃফসল হিসেবে কাসাভা চাষ করা হয়। আন্তঃফসল চাষের কারণে কাসাভার ফলনের তেমন কোনো ক্ষতি হয় না। তবে এ ক্ষেত্রে গাছের ঘনত্ব কিছুটা কমিয়ে দিলে চাষে সুবিধা হয়।

ফলনঃ গাছপ্রতি ১৫-১৮ কেজি ফলন পাওয়া যায়। সাধারণত হেক্টরপ্রতি ২৫-৩০ টন ফলন পাওয়া যায়। তবে ভালো ব্যবস্থাপনায় উন্নত জাত চাষ করলে হেক্টরপ্রতি ৫০ থেকে ৬০ পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়।

বাজারজাতঃ সঠিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে কাসাভা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ইতোমধ্যে বেসরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কাসাভা থেকে আটা ও স্টার্চ তৈরি করে বাজারজাতকরণের উদ্যোগে নিয়েছে।

প্রক্রিয়াজাতঃ কাসাভা আলুকে প্রক্রিয়াজাত করে তা থেকে আটা ও স্টার্চ পাওয়া যায়। এই আটা দিয়ে রুটি থেকে শুরু করে বিভিন্ন খাবার পাওয়া সম্ভব। প্রতি কেজি আলু থেকে আটা ও স্টার্চ মিলিয়ে প্রায় ৩৪০ গ্রাম পর্যন্ত উৎপাদন করা সম্ভব। এক হেক্টর জমি থেকে বছরে প্রায় ২৫.৫ মেট্রিক টন অর্থাৎ ৩ হাজার ৪০০ কেজি কাসাভা আটা ও স্টার্চ পাওয়া সম্ভব।

কাসাভা থেকে তৈরিকৃত খাদ্যসামগ্রীঃ কাসাভার আটা দিয়ে রুটি ছাড়াও পাঁপর, চিপস, নুডলস, ক্র্যাকার্স, বিস্কুট, কেক, পাউরুটি ইত্যাদি তৈরি করা যায়। কাসাভা আলু যেমন সিদ্ধ করে খাওয়া যায়, তেমনই তরকারি করে মাছ-মাংসের সঙ্গে খাওয়া যায়।

বাংলাদেশের যেসব এলাকায় চাষ হচ্ছেঃ ব্যক্তিগত উদ্যোগে কুমিল্লার ময়নামতির টিলা অঞ্চল, মধুপুর গড়, গারো পাহাড় ও চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে কাসাভা চাষ করা হচ্ছে। এখানে চাষকৃত জাতগুলো থাইল্যান্ড ও ভারত থেকে আমদানিকৃত এবং একবর্ষজীবী। এসব জায়গায় উৎপাদিত কাসাভা স্টার্চ উৎপাদনের জন্য কারখানায় ব্যবহৃত হয়। গাছপ্রতি ১৫-১৮ কেজি এবং একরপ্রতি ৬ টনের অধিক ফলন পাওয়া যায়। কুমিল্লায় সাথী ফসল হিসেবে কাসাভার সঙ্গে ছড়াকচু এবং মধুপুর অঞ্চলে সরিষা চাষ করা হয়।

কাসাভার সম্ভাবনাঃ বাংলাদেশের পাহাড়, টিলা, গড় ও শুষ্ক অঞ্চল যেখানে অন্য কোনো ফসল করা যায় না সেখানে কাসাভার চাষ সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। ফসল বহুমুখীকরণ, মঙ্গা মোকাবেলা এবং দেশের পতিত জমিগুলো ফসল চাষের আওতায় নিয়ে আসার জন্য কাসাভা একটি লাগসই ফসল। প্রতি বছর আমাদের দেশের ওষুধশিল্পসহ অন্যান্য শিল্প-কারখানায় প্রচুর পরিমাণে স্টার্চ ও সুক্রোজ প্রয়োজন হয়, যা সাধারণত বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। দেশের পতিত এলাকাগুলো লিজ ভিত্তিতে সহজে কাসাভা চাষের আওতায় নিয়ে এসে স্টার্চের এ চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

As you found this post useful...

Follow us on social media!

We are sorry that this post was not useful for you!

Let us improve this post!

Please don't forget to share this article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি। সকল স্বত্ব www.agriculturelearning.com কর্তৃক সংরক্ষিত