তাল বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অপ্রচলিত ফল। নারিকেল, খেজুর, সুপারির মতো তালও Palmae পরিবারভুক্ত। তাল গাছের শিকড় মাটির বেশি গভীরে পৌঁছে না তবে শতাধিক গুচ্ছ মূল চারদিকে সমানভাবে ছড়িয়ে মাটিকে শক্ত করে ধরে রাখে। প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা (ঝড়, সাইক্লোন) থেকে গাছকে রক্ষা ও ভূমির ক্ষয় রোধ করে। বয়স্ক গাছ ৬০-৮০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। গাছের আগায় ৩৫-৫০টা শক্ত পাতা থাকে। পাতার আগা সূচালো হওয়ায় বজ্রপাত রোধক গাছ হিসেবে এ ফলের আবাদ অতি জনপ্রিয়। একই কারণে বজ্রপাতের কবল থেকে প্রাণিকুলকে রক্ষা করার জন্য ও গাছের বহুবিধ ব্যবহার সুবিধাকে কাজে লাগানোর লক্ষ্যে তাল ফল সম্প্রসারণে বাংলাদেশ সরকার ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১০ লাখ তাল চারা রোপণ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ইতোপূর্বে ডিএই ২ লাখ তাল বীজ/চারা সারা দেশে রোপণ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
বাংলাদেশের সব এলাকায় কমবেশি তাল উৎপাদন হলেও ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, রাজশাহী ও খুলনা এলাকায় সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয়।
জাতঃ তালের কোন অনুমেদিত জাত নেই। তবে এদেশে বিভিন্ন আকার ও রঙের তাল দেখা যায়। আবার কোন কোন তাল গাছের বারমাসই কমবেশি তাল ধরে থাকে। খেজুর, লটকনের মতো তাল গাছের পুরুষ ও স্ত্রী গাছ আলাদাভাবে জন্মে। এজন্য টিস্যু কালচার বা অনুরূপ ব্যবস্থায় বংশবিস্তার ব্যবস্থা ছাড়া বীজ থেকে প্রাপ্ত চারায় জাতের বৈশিষ্ট্যতা বজায় রাখা সম্ভব হয় না।
পুষ্টিগুণ ও ঔষধিগুণঃ তাল পুষ্টিকর ও ঔষধিগুণ সমৃদ্ধ। তাল ভিটামিন ও মিনারেলস সমৃদ্ধ হলেও এতে অন্যান্য ফলের তুলনায় ক্যালসিয়াম, লৌহ, আঁশ ও ক্যালোরির উপস্থিতি অনেক বেশি। আখের গুড়ের চেয়ে তালের গুড়ে প্রোটিন, ফ্যাট ও মিনারেলসের উপস্থিতি বেশি।
তালের রস আমাশয় নিরাময়, মূত্রের প্রবাহ বৃদ্ধিকারক এবং পেটের পীড়া/প্রদাহ, কোষ্ঠকাঠিন্য নিরসনে সহায়ক। এ ফলের রস সেবনে ক্লান্তি দূর করে, দেহে শক্তি জোগায় এবং অনিদ্রা দূর করে। তালের রস থেকে তৈরি মিসরি সর্দি-কাশি নিবারণে বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য মহৌষধ হিসেবে কাজ করে।
তালের বপন/রোপণ প্রযুক্তি
জমি নির্বাচন ও তৈরিঃ প্রায় সব ধরনের মাটিতেই তাল ফসলের আবাদ করা যায়। তবে উঁচুজমিতে এবং ভারী মাটি এটি চাষের জন্য বেশি উপযোগী।
বীজ সংগ্রহ ও নির্বাচনঃ আগষ্ট মাস থেকে তাল পাকতে শুর্ব করে এবং অক্টোবর মাস পর্যন্ত পাকা তাল পাওয়া যায়। তাল বীজ সংগ্রহ করে নির্বাচন করা উত্তম। তবে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নির্বাচিত মাতৃবৃৰ হতে তালের বীজ সংগ্রহ করা উচিত।
বীজ বপনের সময়ঃ ভাদ্র হতে কার্তিক মাস বীজ বপনের উপযুক্ত সময়।
বীজ বপনের দূরত্বঃ সারি থেকে সারি ৭ মিটার এবং চারা থেকে চারা ৭ মিটার
গর্ত তৈরি ও প্রাথমিক সার প্রয়োগ: গর্তের আকার হবে সোয়া ৩ ফুট চওড়া ও সোয়া ৩ ফুট গভীর। গর্ত করার ১০-১৫ দিন পর প্রতি গর্তে ১৫-২০ কেজি জৈব সার, ২৫০ গ্রাম টি এস পি এবং ২০০ গ্রাম এমপি মাটির সাথে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে।
বংশ বিস্তারঃ বীজের মাধ্যমে তালের বংশ বিস্তার হয়ে থাকে। দুইভাবে তাল গাছ লাগানো যায়। একটি পদ্বতি হলো সরাসরি বীজ বপন করে অথবা বীজতলায় চারা উৎপাদন করে চারা রোপনের মাধ্যমে আবাদ করা যায়।
আমাদের দেশে অন্য ফলের মতো বাগান আকারে তাল চাষের প্রচলন নেই। আগস্ট-অক্টোবর মাসে পাকা তাল প্রাপ্তির ভরা মৌসুম। পাকা তাল বা বীজ কোনোভাবে জমিতে, রাস্তা, পুকুর বা দিঘির পাড়ে পড়ে থাকলে তা থেকেই নতুন গাছের সৃষ্টি হয়। যেহেতু বীজ গজিয়ে চারা তৈরি করে তা থেকে ফল পেতে ১০-১২ বছর সময় লেগে যায়, এজন্য অন্য ফলের মতো বসতবাড়িতে বা বাগান আকারে তাল গাছ রোপণে কারো আগ্রহ দেখা যায় না। তবে রাস্তা, বাঁধের ধার, চিংড়ির ঘের, রেললাইনের পাশে ও অন্য কমিউনিটি স্থানে বৃক্ষ রোপণে বিশেষ লাভবান হওয়া যায়।
চারা তৈরিঃ চারা তৈরির জন্য প্রথমে ভালো উন্নত মানের বেশি ফলদানে সক্ষম এমন মাতৃগাছ নির্বাচন করে তা থেকে বীজ সংগ্রহ করা উচিত। পাকা ফল সংগ্রহের দুই সপ্তাহের মধ্যে রোপণ করা উচিত। অন্যথায় বীজ শুকিয়ে গেলে তা থেকে চারা গজায় না। অসময়ে তাল প্রাপ্তির প্রয়োজনে বারোমাসি জাতের গাছ থেকে তাল বীজ সংগ্রহ করা উত্তম।
আগস্ট মাস থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত তাল পাকে। এ সময় তাল বীজ বেশি সংগ্রহ সুবিধা রয়েছে। তবে বারোমাসি জাতের তালের বীজ এপ্রিল-মে মাসের মধ্যে সংগ্রহ করে সরাসরি বীজ রোপণ অথবা জুলাই-আগস্ট মাসের মধ্যে তৈরি চারা রোপণ করা বেশি উপযোগী। বিশেষ করে হাওর অঞ্চলে চারা রোপণের ক্ষেত্রে আগাম চারা তৈরি করে নিয়ে হাওরের কিনারের অপেক্ষাকৃত উঁচু জমি থেকে পানি নেমে গেলে সেসব স্থানে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে চারা রোপণ কাজ শেষ করা উত্তম।
প্রায় ১০ ফুট লম্বা এবং ৩ ফুট চওড়া বীজতলায় এক হাজার তালের আঁটি বা বীজ বসানো যায়। বীজ থেকে চারা গজানোর সময় শিকড় দ্রুত মাটির নিচে প্রবেশ করে এবং তা উঠিয়ে পলিব্যাগে সংরক্ষণ করা কষ্টকর হয়। এ অবস্থায় মাটি থেকে চারা উঠালে অধিকাংশ চারা মারা যেতে পারে। এজন্য বীজ তলার নিচের অংশে পাতলা টিনের শিট বা পুরু পলিথিন বিছিয়ে অথবা তলার এ অংশ ২-৩ ইঞ্চি পুরু করে সিমেন্ট বালি খোয়া দিয়ে ঢালাই করে নিয়ে তা তালের চারা তৈরির কাজে ব্যবহার করলে সুবিধা হয়, তাতে শিকড় মাটির ভেতরে প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হয়। এতে গজানো আঁটি সহজেই উঠিয়ে পলিব্যাগে সংরক্ষণ উপযোগী হয়।
বীজতলা তৈরিকালে নিচের অংশ কম্পোস্ট/পচা গোবর ও ছাই মিশ্রিত বেলে-দো-আঁশ মাটি দিয়ে ৩ ইঞ্চি পরিমাণ ভরাট করে তাতে সারি করে বীজ বসাতে হয়। বীজগুলো বসানো হলে মোটা বালু ও মাটির মিশ্রণ দিয়ে প্রায় ১ ইঞ্চি (২-৩ সেমি) পুরু করে বসানো বীজের উপরিভাগ ঢেকে দিতে হয়। বীজতলার মাটিতে নিয়মিত হালকা পানি সেচ দিয়ে ভেজাতে হয়।
বীজ বপনের ৩-৪ সপ্তাহের মধ্যে বীজ অঙ্কুরিত হওয়া শুরু হবে। গজানো বীজ থেকে মোটা শিকড়ের মতো নরম, আগা কিছুটা সূচালো এক প্রকার টিউব তৈরি হয়। এ টিউবের মধ্যে শিকড় ও সুপ্ত পাতা একই সঙ্গে বড় হয়ে ৮-১০ সপ্তাহের মধ্যে গজানো পাতা প্রায় ৭-১৫ ইঞ্চি লম্বা হয়। পাতা বের হওয়া শুরু হলে টিউবের আবরণ শুকিয়ে বা পচে ভেতরের পাতা ও শিকড় আলাদাভাবে বড় হওয়া শুরু করে। এ সময় চারাগুলো আঁটিসহ উঠিয়ে পুরু শক্ত ১০ x ১০ ইঞ্চি মাপের পলিব্যাগে অথবা পরিত্যক্ত সিমেন্টের বস্তা দিয়ে তৈরি ব্যাগে ভালো মানের পটিং মিডিয়া (বেলে দো-আঁশ মাটি ৫০%, জৈব পদার্থ ৪০% এবং ১০% কেকোডাস্ট/করাত কলের গুঁড়া) ব্যবহার করে তা সংরক্ষণ ব্যবস্থা নেয়া হয়।
অনেক সময় তৈরি নতুন চারার শিকড় বেশি বড় হয়, এ ক্ষেত্রে ব্যাগিং করার সময় কাজের সুবিধার্থে গাজানো শিকড় ৪-৬ ইঞ্চি রেখে অবশিষ্ট অংশ সিকেচার বা ধারালো চাকু দিয়ে কেটে ফেলা উত্তম হবে। চারা ব্যাগিং করার প্রথম ২-৩ সপ্তাহ হালকা ছায়া দেয়ার ব্যবস্থা করা ভালো।
মাঠে চারা রোপণ: মৌসুমী বৃষ্টিপাত আরম্ভ হওয়ার পরপরই পলিব্যাগে উত্তোলিত ৩০-৩৫ সে. মি. লন্ব পাতা বিশিষ্ট চারা মাঠে রোপণ করা উচিত। তবে মাটিতে প্রচুর পরিমাণে আর্দ্রতা থাকলে অথবা পানি সেচের ব্যবস্থা থাকলে চারা এপ্রিল- মে মাস পর্যন্ত লাগানো যেতে পারে। সমতল ভূমিতে অন্যান্য প্রজাতির পলিব্যাগের চারার মতোই এ চারা লাগাতে হবে। চারা লাগানোর নির্দিষ্ট স্থানে পলিব্যাগের আকৃতি অনুসারে অগার দিয়ে গর্ত করে পলিথিন ছিড়ে পলিব্যাগের মাটিসহ চারা গর্তে বসাতে হবে। গুড়ো মাটি দিয়ে গর্তের ফাঁক ভরাটসহ ভালোভাবে চারার গোড়ার মাটি চেপে দিতে হবে। চারাগুলো আগাছমুক্ত রাখা ও গবাদি পশুর উপদ্রব থেবে রৰার ব্যবস্থা দিতে হবে। চারা রোপণের পর অন্তত প্রথম তিন বছর রোগ- বালাই ও কীটপতঙ্গের আক্রমণের হাত হতে চারা করা আবশ্যাক।
ফল সংগ্রহঃ ফল সংগ্রহ করতে মোটামুটি ৮-১০ বছর লাগে ।মধ্য পৌষ থেকে মধ্য চৈত্র (জানুয়ারি থেকে মার্চ) মাসে ফুল আসে এবং শ্রাবণ- ভাদ্র মাসে ফল পাকতে শুরু করে। প্রতি গাছে প্রায় ১৫০- ২৫০ টি ফল ধরে। তালের ব্যবহার তালের রস বিভিন্ন প্রকার পিঠা , মিছরি ও গুড় তৈরীতে ব্যবহার হয়। সদ্য আহরিত তালের রস পানীয়। তালগাছের পাতা ও আঁশ পাখা ও অন্যান্য কুটির শিল্পজাত দ্রব্য তৈরীর জন্য ব্যবহার করা যায়। বয়স্ক তালগাছ থেকে উৎকৃষ্ট মানের কাঠ পাওয়া যায় যা গৃহ নির্মান ও সৌখিন দ্রব্য প্রস্তুত করা জন্য ব্যবহার করা হয়। পাকা তালের রস কনফেকশনারীতে শুকনো খাবার প্রস্তুত করণের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
 
How useful was this post?
Click on a star to rate it!
We are sorry that this post was not useful for you!
Let us improve this post!
Thanks for your feedback!