About Us Contact Us Privacy Policy Terms & Conditions Copyright

গৌড়মতি নাবি জাতের নতুন আম। গৌড়মতি আমের বৈশিষ্ট্য ও রোগবালাই

Please don't forget to share this article

গৌড়মতি নাবি জাতের একটি নতুন আম। এই আমটি ল্যাংড়া আমের চেয়েও খেতে সুস্বাদু ও অনেক সুমিষ্ট। রাজশাহীর চাঁপাইনাবগঞ্জে এই আমটির সন্ধান পাওয়া গেছে। ২০১২ সালে তৎকালীন কৃষিবিদ মঞ্জুরুল হক,সংগনিরোধ কীটতত্ববিদ, চাঁপাইনাবগঞ্জ, স্থানীয় বাজার থেকে গুটি ল্যাংড়া নামের আম কিনেছিলেন সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। তখন ল্যাংড়া, হিমসাগর বা ফজলি থেকে শুরু করে প্রায় সব ভালো জাতের আমের মৌসুম শেষ। তাই ঐ আমটি যে গুটি ল্যাংড়া নয় তা তিনি নিশ্চিত হন। আমটি খেয়ে তিনি বুঝেছিলেন এটি একটি ভালো জাতের আম।

পরবর্তীতে মঞ্জুরুল হক আম গাছটির সন্ধানে বের হন এবং সোনামসজিদ থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরের শিয়ালমারা গ্রামে গিয়ে গাছটির সন্ধান পান। সেখান থেকে তিনি ১০টি ডাল ও দুটি আম সংগ্রহ করেন। এরপর চাঁপাইনাবগঞ্জ কল্যাণপুর হর্টিকালচার সেন্টারে ৫ টি ডাল ও একটি আম দিয়ে নিজের কাছে ৫ টি ডাল ও একটি আম রেখে ঐ ডালগুলো দিয়ে পরবর্তীতে আরো চারা সম্প্রসারণ করেন। তিনি প্রথমে ক্লোনাল হেজ পদ্ধতিতে ৩ ফিট দূরে দূরে সঠিকভাবে সার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ৪০ আম গাছের চারা করেন।

পরবর্তীতে রাজশাহীর পবা উপজেলার মতিয়াবিলে ২১ কাঠা জমিতে গৌড়মতি আমের চারার নার্সারি করেছেন কৃষিবিদ মঞ্জুরুল হক। ইতিমধ্যে তাঁর বাগান থেকে প্রায় ১০ হাজার চারা সারাদেশে বিক্রি হয়েছে। প্রায় ১০০টি মাতৃ গাছ থেকে চারা তৈরি হচ্ছে। তিনি অনেক চারা বিলিও করেছেন। প্রতি বছর তাঁর বাগান থেকে প্রচুর গৌড়মতি আমের চারা বিক্রি হচ্ছে।

আমের গৌড়মতি নামকরণঃ স্বাদে ও গন্ধে অতুলনীয় নতুন জাতের এ আমের ‘গৌড়মতি’ নামকরণ করেছেন কৃষিবিদ মঞ্জুরুল হক। তিনি বর্তমানে রাজশাহী কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের জেলা প্রশিক্ষণ অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি জানিয়েছেন, আমটির সর্বপ্রথম সন্ধান পাওয়া যায় চাঁপাইনবাবগঞ্জে। তাই বাংলার প্রাচীন এই জনপদের ‘গৌড়’ থেকে ‘গৌড়’ আর মূল্য বিবেচনায় রত্নের সঙ্গে তুলনা করে ‘মতি’ শব্দের সমন্বয়ে নতুন জাতের এই আমটির ২০১৩ সালে নামকরণ করা হয়েছিল ‘গৌড়মতি’।

কৃষিবিদ আবু হানিফ মিয়া, পরিচালক,উদ্ভিদ সংগনিরোধ উইং এর সহযোগিতায় গৌড়মতি আমের উদ্ভাবনের জন্য কৃষিবিদ মঞ্জুরুল হক ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে কেআইবি কৃষি পদক পেয়েছেন।

গৌড়মতি আমের বৈশিষ্ট্যঃ

  • এই আমের টোটাল সলিউবল সুগার (টিএসএস) প্রায় ২৫ শতাংশ।
  • এই আমটি নাবি জাতের। নাবি জাতের হলেও মুকুল অন্যান্য জাতের মতো একই সময়ে আসে।
  • এই আমটি ল্যাংড়া বা ক্ষিরসাপাত অর্থাৎ হিমসাগরের চেয়ে ১৭- ২০ % বেশি মিষ্টি।
  • গৌড়মতির ভক্ষণযোগ্য অংশ প্রায় ৯৩ ভাগ সেখানে অন্যান্য ভালো জাতের আমের ভক্ষণযোগ্য অংশ ৮০-৮২ ভাগ।
  • আমটি পাকলে হলুদাভার সঙ্গে সিঁদুরে রঙের মিশ্রণে অসাধারণ দেখায়।
  • গৌড়মতি আমে মিষ্টতার পাশাপাশি উচ্চমাত্রার খনিজ উপাদানও রয়েছে।
  • এই আমের খোসা ও আঁটি দুটোই পাতলা এবং আঁটি ছোট হওয়ায় এ আমের ভক্ষণযোগ্য অংশ বেশি।
  • ল্যাংড়া ও আশ্বিনার প্রাকৃতিক পরাগায়নের ফলে আমের নতুন এ জাতটির উদ্ভাবন হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
  • এই আমটি দেখতে অনেকটা ল্যাংড়া ও আশ্বিনা জাতের আমের মতো। অর্থাৎ আশ্বিনা থেকে নাবি জাতের বৈশিষ্ট্য এবং ল্যাংড়া থেকে রং, আকৃতি ও স্বাদসহ অন্যান্য বৈশিষ্ট্য পেয়েছে এ আমটি।
  • আমটি সহজে পচনশীল নয়। কেননা পাকা আম গাছ থেকে পাড়ার ৭-১০ দিন পরও আম ভালো থাকে।
  • এই আম আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত পাকবে।
  • প্রতিটি আমের ওজন প্রায় ৩৫০ থেকে ৬০০ গ্রাম অর্থাৎ গড়ে ৩ টি আমের ওজন ১ কেজি।
  • এই আম স্বাদে, মিষ্টতায় ও গন্ধে তুলনাহীন।
  • প্রতি কেজি আমের বাজার দাম কমপক্ষে ৩৫০-৪০০ টাকা।
  • সাধারণত ৩ বছর বয়সের চারা গাছে ফল ধরে থাকে। ৪ বছর বয়সের প্রতিটি গাছ থেকে ১ মণ এবং ৫ বছরের প্রতিটি গাছ থেকে প্রায় ১.৫ মণ আম পাওয়া যায়।
  • এই গাছের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো প্রতি গাছে আম ধরার পরে ঐ গাছের কাণ্ড বা গোড়া থেকে ৩ বার ফ্লাস বা নতুন পাতা বের হয়। যার ফলে প্রতি বছরই গাছে ফল ধরে। এই জাতের আম গাছের ফল ধারণ ক্ষমতা অনেক বেশি।

গৌড়মতি আমের রোগ ও পোকামাকড়ঃ উচ্চ ফলনশীল বিধায় নতুন জাতের এই আমে পোকামাকড়ের আক্রমণ বেশি হয়ে থাকে। এই আমে প্রধানত এ্যানথ্রাকনোজ রোগের আক্রমণ বেশি দেখা যায়। পোকামাকড়ের মধ্যে ফলের মাছি পোকার উপদ্রপ বেশি দেখা যায়।

এ্যানথ্রাকনোজ রোগের লক্ষণঃ

  • গাছের সব স্টেজে অর্থাৎ গাছের পাতা, পাতার বোটা, কচি কাণ্ড, ডাল, মুকুল ও ফলে এ রোগের আক্রমণ পরিলক্ষিত হয়ে থাকে।
  • প্রথমে গাছের পাতা ও কচি ডালে অসম আকৃতির ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ধূসর বাদামি রঙের দাগ দেখা যায়। পরবর্তীতে দাগগুলো বৃদ্ধি পেয়ে কয়েকটি দাগ একত্রিত হয়ে বড় দাগের সৃষ্টি হয়।
  • কচি পাতাই বেশি পরিমাণে আক্রমণের ফলে কচি ডাল আগা থেকে শুকিয়ে যেতে থাকে।
  • পাতার বোটা কালো হয়ে ঝরে যায়। পরবর্তীতে পাতার বোটা থেকে রোগ ডালে সংক্রমিত হলে ডালের গায়ে কালো দাগ উৎপন্ন হয়ে থাকে।
  • সাধারণত মুকুল বা ফুল রোগাক্রান্ত হলে তা কালো হয়ে ঝরে পড়ে এবং পুষ্পদন্ড শুকিয়ে যায়।
  • গাছে আম ছোট থাকা অবস্থায় আক্রান্ত হলে আমের গায়ে কালো কালো দাগ পড়ে এবং আম ঝরে পড়ে। তবে বড় আমও আক্রান্ত হলে আমের গায়ে ধূসর বাদামি বা কালো দাগ পড়ে। এই রোগের আক্রমণে সম্পূর্ন আমটিও পচে যেতে পারে।
  • কিছু কিছু ক্ষেত্রে আক্রান্ত অংশ বা কাণ্ড ফেটে গিয়ে আঠা ঝরতে থাকে ও ক্ষতের সৃষ্টি হয়।

এ্যানথ্রাকনোজ রোগের প্রতিকারঃ

  • গাছ থেকে আম সংগ্রহের পর গাছের মরা ডাল কেটে পুড়িয়ে ফেলতে হবে এবং কাটা অংশে এবং ফাটা কাণ্ড থেকে রস ঝরা অংশে ক্ষত পরিস্কার করে বর্দোপেষ্ট (প্রতি লিটার পানিতে ১০০ গ্রাম তুঁতে ও ১০০ গ্রাম চুন) ৭-৮ দিন পর পর লাগাতে হবে।
  • বাগানের গাছের নীচে পড়ে থাকা যাবতীয় পরিত্যক্ত অংশ কিছুদিন পর পর সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
  • গাছে মুকুল আসার পর কিন্তু ফুল ফোটার পূর্বে ট্রাইসাইক্লাজল (ট্রুপার, ডাইফা, জিল) ২ গ্রাম/ লিটার পানিতে অথবা টেবুকোনাজল+ট্রাইফ্লক্সিস্ট্রবিন ( নাটিভো ) ০.৫ গ্রাম/লিটার পানিতে অথবা প্রোপিকোনাজল ( টিল্ট ০.৫ মিলি/লিটার) অথবা হেক্সাকোনাজল ( কনটাফ/কনজা ১ মিলি/লিটার) পানিতে মিশিয়ে আম গাছের মুকুল, পাতা, শাখা প্রশাখা ও কান্ডে ভালোভাবে একবার স্প্রে করতে হবে। পরবর্তীতে আম গুটি বা মার্বেল আকার ধারণ করলে উপরিউক্ত ছত্রাকনাশক আরও একবার  স্প্রে করতে হবে।

ফলের মাছি পোকার লক্ষণঃ

  • স্ত্রী পোকা ডিম পাড়ার অঙ্গ অর্থাৎ অভিপজিটরের পাকা আমের ভিতর ডুকিয়ে ডিম পাড়ে অর্থাৎ খোসার নিচে ডিম পাড়ে।
  • পরবর্তীতে ১-৩ দিনের মধ্যে ডিম থেকে কীড়া বের হয়ে ফলের মাংশল অংশ খেয়ে থাকে এবং ফল পচে যায়।
  • আক্রান্ত পাকা আম কাটলে ভেতের অংশে সাদা রঙের কীড়া দেখা যায়। মাছি পোকা সাধারণত আমের ওপর এবং নিচ উভয় অংশে আক্রমণ করে থাকে।

প্রতিকারঃ

  • আক্রান্ত আম গাছ থেকে সংগ্রহ করে মাটির নিচে গর্ত করে পুঁতে ফেলতে হবে।
  • ফল ব্যাগিং করে এই পোকা দমন করা যায়। এক্ষেত্রে ব্রাউন বা সাদা পেপার দিয়ে ব্যাগিং করা যাবে। তবে গৌড়মতি আমের ক্ষেত্রে ব্রাউন পেপার দিয়ে ব্যাগিং করলে আমের মিষ্টতা ও স্বাদ কমে যায়। আর সাদা পেপার দিয়ে করলে সহজেই নষ্ট হয়ে যায় এবং এক মৌসুমে ২ বার ব্যাগিং করতে হয়। তাতে খরচ বেড়ে যায়।
  • তাই গৌড়মতি আমের জন্য নেট বা জাল দিয়ে পুরো আম গাছ ঢেকে দিয়ে মাছি পোকা দমণ করাই উত্তম।
  • ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে প্রচুর পুরুষ পোকা মারা যাবে এবং বাগানে মাছি পোকার আক্রমণ কমে যাবে।

প্রাপ্তি স্থানঃ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার সেন্টার, কল্যাণপুর,চাপাইনবাবগঞ্জে মাতৃগাছ থেকে অনেক চারা তৈরী করা হয়েছে। ড.সাইফুর রহমান,উপপরিচালক, হর্টিকালচার সেন্টার,কল্যাণপুর,চাপাইনবাবগঞ্জ জানিয়েছেন, তার তত্ত্বাবধানে দেশের ২১টি হর্টিকালচার সেন্টারে ‘গৌড়মতি’আমের জাত নিয়ে পরীক্ষা চলছে। দেশের অন্যান্য হর্টিকালচার সেন্টার এবং ব্যক্তি পর্যায়েও গৌড়মতির কিছু মাতৃগাছ ও চারা পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়াও রাজশাহীর পবা উপজেলায় কৃষিবিদ মঞ্জুরুল হকের নার্সারিতে গৌড়মতি আমের চারা পাওয়া যাবে। প্রতিটি গৌড়মতি আমের চারার মূল্য ৩০০-৪০০ টাকা।

সম্ভাবনাঃ ‘গৌড়মতি’ বাংলাদেশের জন্য খুবই সম্ভাবনাময় নাবি জাতের একটি আম। এই আমের মাধ্যমে যেমন অসময়ে আমের চাহিদা মিটবে তেমনি ভালো বাজার মূল্য পেয়ে আম চাষিরা লাভবান হতে পারবেন বলে আশা করা যায়। ফলে নতুন জাতের এই আমটি সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে পারলে আমের জগতে নতুন এক বিপ্লব ঘটবে।

বিঃদ্রঃ গৌড়মতি আম ছাদে ড্রামে বা টবে লাগালে ভালো ফলাফল পাওয়া যায় না বিধায় না লাগানোই ভালো।

 

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

As you found this post useful...

Follow us on social media!

We are sorry that this post was not useful for you!

Let us improve this post!

Please don't forget to share this article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি। সকল স্বত্ব www.agriculturelearning.com কর্তৃক সংরক্ষিত