Agriculturelearning

সেক্স ফেরোমন ফাঁদ তৈরি ও স্থাপন পদ্ধতি। জমিতে ফাঁদ ব্যবহারের সুবিধা

Please don't forget to share this article

সেক্স ফেরোমন ফাঁদঃ

সেক্স ফেরোমন ফাঁদ হচ্ছে এক ধরনের কীটপতঙ্গের দমন পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে প্লাস্টিকের বক্স ব্যবহার করা হয়। যার দু’পাশে ত্রিকোনাকৃতি ফাঁক থাকে। পুরুষ পোকাকে আকৃষ্ট করতে স্ত্রী পোকা কর্তৃক নিঃসৃত এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ (স্ত্রী পোকার গন্ধ) ব্যবহার করা হয়, যা সেক্স ফেরোমন নামে পরিচিত। কুমড়াজাতীয় ফসল, সবজিসহ নানা চাষাবাদে এ পদ্ধতির চমকপ্রদ কার্যকারিতার কারণে কৃষকদের মাঝে এটি জাদুর ফাঁদ বা তাবিজ নামেও পরিচিত। কেননা  লিউরটি দেখতে তাবিজের মতো।

ফাঁদের প্রয়োজনীয় উপকরণ ও বাজার মুল্যঃ

সেক্স ফেরোমন ফাঁদের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়- সেক্স ফেরোমন টোপ (লিউর বা কিউলিউর), প্লাষ্টিক বৈয়াম, তার, সাবান গুড়া, পানি ও বাঁশের খুটি। লিউরটি বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। বাজারে বয়াম সহ কিনলে দাম বেশি নিবে। বয়ামসহ প্রায় ৬৫-৭০ টাকা। বয়াম ছাড়া শুধু লিউরের দাম ২৫-৩০ টাকা। আমাদের দেশে ইস্পাহানী কোম্পানী বিভিন্ন ধরনের সবজি ও ফলের সেক্স ফেরোম্যান ফাঁদ কৃষক পর্যায়ে বাজারজাত করছে।

সেক্স ফেরোমন ফাঁদ তৈরি ও স্থাপন পদ্ধতিঃ

এ পদ্ধতি ব্যবহার করতে হলে আগে ফাঁদ বা টোপ তৈরি করতে হয়। এ টোপ তৈরী করতে খেতের মাঝখানে বাঁশের খুঁটিতে পাস্টিকের পাত্র (বয়াম) স্থাপন করতে হবে। ওই পাত্রের তলা হতে উপরের দিকে কমপক্ষে তিন–চার সেন্টিমিটার পর্যন্ত সাবান মিশ্রিত পানি রাখতে হবে। প্লাস্টিক পাত্রের উপরের পানি হতে এক–দেড় ইঞ্চি উপরে সেক্স ফেরোমন টোপটি (লিউর) একটি সরু তার দিয়ে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। এ রকম ১২–১৫ মিটার দূরে বর্গাকারে জমিতে ফেরোমন ফাঁদ বসাতে হবে। অথবা প্রতি তিন শতাংশ জমিতে একটি ফাঁদ ব্যবহার করা যেতে পারে। একটি টোপ ৪৫–৫০ দিন অর্থাৎ এক মৌসুমে দুইটি টোপ ব্যবহার করতে হবে। গরমের সময় তিন দিন, শীতের সময় ৫ থেকে ৬ দিন পর পর সাবানের পানি বদলাতে হবে। বৃষ্টির পানি ঢুকলে বদলিয়ে দিতে হবে। এছাড়াও চানাচুর, বিস্কুটের বয়াম দিয়ে ফাঁদ তৈরি করা যায়। তাই শুধু লিউর কিনলেই চলবে। বয়ামে মুখায় ছিদ্র করে সুতা ঝুলিয়ে লিউর বেঁধে দিতে হবে। বয়ামের মাঝ বরাবর উভয় পাশে ত্রিভুজাকৃতির জানালা কাটতে হবে।

বিভিন্ন ধরনের সেক্স ফেরোমনঃ

বিভিন্ন প্রকার সেক্স ফেরোমোন ফাঁদ পাওয়া যায়। যথা ডেল্টা ফাঁদ, উইং বা ডানা ফাঁদ, ফানেল ফাঁদ এবং পানি ফাঁদ এসব প্রচলিত রয়েছে। তবে মাঠ পর্যায়ে পানি ফাঁদ পদ্ধতিটি বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে।

পানি ফাঁদ তৈরির পদ্ধতিঃ

প্রায় ৩ লিটার পানি ধরে এবং প্রায় ২২ সে.মি লম্বা গোলাকার বা চারকোনা বিশিষ্ট প্লাস্টিকের পাত্র বা বৈয়াম দিয়ে এ ফাঁদ তৈরি করা যায়। বৈয়ামের উভয় পাশে ১০ থেকে ১২ সে.মি চওড়া এবং  ১১ থেকে ১২ সে.মি উঁচু পরিমাণ অংশ ত্রিভূজের মত করে কেটে নিতে হবে। পাত্রের তলা হতে কাটা অংশের নিচের দিকে কমপক্ষে ৪ থেকে ৫ সেমি পর্যন্ত সাবান মিশ্রিত পানি দিয়ে ভরে রাখতে হবে। বৈয়ামের ঢাকনার মাঝে কালো রংয়ের একটি ল্যুপ বসানো থাকে। ল্যুপের নিচের ছিদ্রে চিকন তার বাঁধা হয়। তারের অপর মাথায় ফেরোমোন সম্বলিত টিউব বা লিউরটি এমনভাবে বাঁধতে হবে যেন লিউরটি সাবান মিশ্রিত পানি হতে ২ থেকে ৩ সেমি উপরে ঝুলতে থাকে। সেক্স ফেরোমনের গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে পুরুষ পোকা বৈয়ামের ভেতরে প্রবেশ করে এবং লিউরটির চারপাশে উড়তে যেয়ে সাবান মিশ্রিত পানিতে পড়ে মারা যায়। যত্নের সাথে ব্যবহার করা হলে একটি ফাঁদ ৩ থেকে ৪ মৌসুম পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়।

যেসব ফসলে ফেরোমন ফাঁদটি ব্যবহৃত হয়ঃ

কুমড়া জাতীয় সবজি, বেগুন,করলা, শসা, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, লাউ, ঝিঙে, পটল, চিচিংগা, কাকরোল, উচ্ছে, তরমুজ, ফুলকপি, বাধাকপি, খিরা, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়া, শসা, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, তরমুজ, বাঙ্গি ইত্যাদি ফসলের জন্য এ পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া ফল জাতীয় গাছের মধ্যে আম, লিচু, পেয়ারা এসব গাছেও আজকাল সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করা হচ্ছে।

ফাঁদের মাধ্যমে পোকার বংশবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণঃ

ফাঁদে ব্যবহূত বক্সটিতে স্ত্রী পোকার নিঃসৃত গন্ধকে কৃত্রিমভাবে ১০০ গুণ বৃদ্ধি করা হয়। যাতে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ পোকা বক্সের ভেতরে বা আশেপাশে স্ত্রী পোকা আছে ভেবে খুঁজতে থাকে। পুরুষ পোকা গন্ধ পেয়ে লিউরের নিকট আসলে মাতাল হয়ে পাত্রের তলায় সাবান বা ডিটারজেন্ট মিশ্রিত পানিতে পড়বে। পানি আঠালো হওয়ার কারণে আর উঠতে পারবে না, পোকাগুলো ফাঁদের ভেতর মারা যাবে। ধীরে ধীরে সকল পুরুষ পোকা মারা যাবে। ফলে স্ত্রী পোকার ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবে না। অব্যাহতভাবে পুরুষ পোকা এ ফাঁদে মারা যাওয়ায় স্ত্রী পোকার বংশ বৃদ্ধি ব্যাহত হবে। পরবর্তী বংশধর না হওয়ায় পোকা আর থাকবে না। এভাবে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ পোকা মারার মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি বন্ধ করে পোকা দমন করা হয় ।

ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহারের সুবিধাঃ

জমিতে ফেরোমন ফাঁদ স্থাপনের সময় এবং পদ্ধতিঃ

বেগুন ফসলের জমিতে সাধারণত চারা রোপণের ৪ থেকে ৫ সপ্তাহ পর থেকে বেগুনের কচি ডগায় ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ শুরু হয়। এজন্য বেগুনের চারা রোপণের ৪ থেকে ৫ সপ্তাহ পর থেকে ফাঁদ স্থাপন করতে হবে। কুমড়া জাতীয় ফসলের জন্য ফুল ফোটার আগেই জমিতে ফাঁদ বসাতে হবে। সফলভাবে পোকা দমনের জন্য শেষবার ফসল সংগ্রহ করা পর্যন্ত ফেরোমোন ফাঁদ জমিতে রাখতে হবে। ফেরোমন ফাঁদ সাধারণত জমির আইলের ২.৫ মিটার ভিতর থেকে শুরু করে ১০ মিটার দূরে দূরে বর্গাকারে স্থাপন করতে হবে। কুমড়াজাতীয় ফসলে ১২ মিটার, ফল বাগানে ১২ মিটার এবং কপি সবজি ক্ষেতে ২৫ মিটার দুরত্বে স্থাপন করতে হবে। বেগুন ক্ষেতে বিঘাপ্রতি ১৩ থেকে ১৪ টি ফাঁদ, কুমড়াজাতীয় সবজি ক্ষেতে বিঘা প্রতি ১১ টি, ফলের মাছি পোকা নিয়ন্ত্রণে বিঘা প্রতি ১১ টি এবং কপি সবজি ক্ষেতে ৬ টি ফাঁদ বসাতে হবে। সাধারণত দুটি খুঁটি শক্তভাবে স্থপন করতে হবে। তারপর ফাঁদটিকে তার বা সুতলি দিয়ে শক্ত করে খুঁটির সাথে বাঁধতে হবে। সবজি ফসলের মাঠে উত্তর দক্ষিণ মুখ করে ফাঁদটি বসাতে হবে। এতে বাতাসকে সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ফসলের উচ্চতা বাড়ার সাথে সাথে ফেরোমোন ফাঁদের উচ্চতাও বাড়াতে হবে। বেগুন গাছের ঠিক উপরে, কুমড়া জাতীয় গাছের মাচা বরাবর ঝুলিয়ে এবং আম, পেয়ারা গাছে মাটি থেকে হাত উচিয়ে যতটুকু উঠানো যায় ঠিক ততোটুকু উচ্চতায় সেক্স ফেরোমন ফাঁদ স্থাপন করতে হয়।

জমিতে ফেরোমন ফাঁদ স্থাপনের পর করণীয়ঃ

সপ্তাহে কমপক্ষে ২ দিন ফাঁদের পানি পরীক্ষা করে মরে থাকা পোকা ফাঁদের পানি থেকে আঙ্গুল বা কাঠি দিয়ে সরিয়ে ফেলতে হবে। ৩ থেকে ৪ দিন পরপর সাবান পানি পাল্টে দিতে হবে। সাবান পানি স্তর সবসময় যেন ৩ থেকে ৪ সেমি পুরু থাকে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। ফাঁটা বা ছিদ্রযুক্ত ফাঁদ পাল্টিয়ে নতুন ফাঁদ প্রতিস্থাপন করতে হবে। তাছাড়া গাছের বৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে ফাঁদটিকেও আস্তে আস্তে উপরের দিকে তুলে দিতে হবে। বেগুন, কপি সবজির লিউরগুলো খুলে দেখা যাবে না। বেগুনের জমিতে নির্দিষ্ট সময় পর পর লিউর পরিবর্তন করে দিতে হবে। তবে অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রে পুরো মৌসুমের জন্য একটি ফেরোমন লিউরই যথেষ্ট। লিউরগুলো ভেজানো যাবে না। লিউর এর প্যাকেট খোলা রাখা যাবে না। তাছাড়া প্যাকেট খোলার সাথে সাথে লিউর ব্যবহার করা উচিত।

সাবধানতাঃ

বেগুন ও কুমড়া জাতীয় ফসলের জন্য আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য বিশিষ্ট সেক্স ফেরোমোন লিউর ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া লিউরগুলোর ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও ভিন্নতা রয়েছে। ফলে লিউরগুলো ব্যবহারের সময় সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। বেগুন ও কপিতে ব্যবহারের জন্য লিউরগুলো অবশ্যই ডিপ ফ্রিজে রাখতে হয়। তা না হলে লিউরের কার্যক্ষমতা দিনে দিনে কমে যায়। অন্যদিকে কুমড়াজাতীয় এবং আম, লিচু, পেয়ারা এসব ফলের লিউরগুলো স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রেফ্রিজারেটর বা নরমাল ফ্রিজে রাখা যায়। লিউরের ভিতর কিছু দেখা না গেলেও তা খুলে দেখা যাবে না। একটি বিষয় লক্ষ্যনীয় যে, বেগুনের একটি লিউর চারপাশে সর্ব্বোচ্চ ১০ মিটার দুরত্ব পর্যন্ত  কার্যকারিতা বিস্তার করতে পারে। অন্য একটি লিউর তার অবস্থান থেকে চারপাশে ১০ মিটার দুরত্ব পর্যন্ত কার্যকারিতা বিস্তার করতে পারে। তাই একটি লিউর থেকে অন্য একটি লিউরের দুরত্ব ২০ মিটার হওয়া উচিত। এভাবে অন্যগুলোও ব্যবহার করতে হবে।

পরিশেষে বলা যায় যে, সেক্স ফেরোমন কিংবা জৈবিক বালাইনাশক ফাঁদ হলো বিষমুক্ত সবজি চাষের একটি আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব জৈবিক পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে খুব কম সময়ে ও কম খরচে অধিক সবজি চাষ করে অনেকে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। তাই বর্তমানে অধিকাংশ কৃষকই এ  লাভজনক পদ্ধতিতে সবজি চাষে আগ্রহী হচ্ছেন।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

As you found this post useful...

Follow us on social media!

We are sorry that this post was not useful for you!

Let us improve this post!

Please don't forget to share this article