About Us Contact Us Privacy Policy Terms & Conditions Copyright

বানিজ্যিকভাবে কোয়েল পালনের পদ্ধতি। কোয়েলের রোগ ও খামার ব্যবস্থাপনা

Please don't forget to share this article

কোয়েলের আদি নিবাস জাপানে। সর্বপ্রথম জাপানী বিজ্ঞানীরা কোয়েলকে গৃহপালিত পাখি হিসেবে পোষ মানানোর উপায় উদ্ভাবন করেছেন। পরবর্তীতে জাপান সহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে কোয়েলকে একটি লাভজনক পোলট্টি উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পোলট্রিতে এগারটি প্রজাতি রয়েছে, তন্মধ্যে কোয়েল একটি ছোট আকারের গৃহপালিত পাখি। হাঁস-মুরগী পালনের মতো ব্যাপক পরিচিত না হলেও কোয়েল পালন বর্তমানে বাংলাদেশে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। কেননা স্বল্প মূল্যে, অল্প জায়গায়, অল্প খাদ্যে কোয়েল পালন করা যায়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, বগুড়াসহ দেশের অনেক জেলাতেই বর্তমানে কোয়েল ফার্ম গড়ে উঠেছে।

বাংলাদেশ পশুসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান (Bangladesh Livestock Research Institute (BLRI)) এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (BAU) পোল্ট্রি বিজ্ঞানীগণ কোয়েলের বিভিন্ন বিষয় গবেষণা করে পর্যবেক্ষণ করেছেন। এদেশের আবহাওয়া বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কোয়েল পালনের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। তাছাড়া অর্থনৈতিক ভাবেও কোয়েল পালন অত্যন্ত লাভজনক। ইতিমধ্যেই কোয়েলের মাংস ও ডিম সারা দেশে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। কোয়েল পালনের খরচ ও ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় অনেকেই কোয়েল পালনকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করছেন।

কোয়েল পালনের সুবিধাঃ

  • এরা আকৃতিতে ছোট বলে সহজেই আবদ্ধাবস্থায় এবং অল্প জায়গায় বেশি সংখ্যায় পালন করা যায়।
  • খরচ কম হওয়ায় যে-কেউ অল্প পুঁজিতে ছোট খাটো খামার দিয়ে ব্যবসা শুরু করতে পারে।
  • ৫ সপ্তাহের মধ্যে (জাপানী কোয়েল) এবং ৮ সপ্তাহের মধ্যে ( ববহোয়াইট কোয়েল) পূর্ণতা লাভ করে এবং মাংসের জন্য ব্রয়লার কোয়েল বাজারজাত করার উপযুক্ত হয়।  ৬-৭ সপ্তাহের মধ্যে (জাপানী কোয়েল) এবং ৮-১০ সপ্তাহের মধ্যে (ববহোয়াইট কোয়েল) ডিমপাড়া শুরু করে।  প্রতিটি জাপানি ও ববহোয়াইট কোয়েলী বছরে যথাক্রমে ২০৫-৩০০ ও ১৫০-২০০ টি ডিম দিয়ে থাকে।
  • ১৭-১৮ দিনের মধ্যে কোয়েলের ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়।
  • কোয়েলের মাংস ও ডিম অত্যন্ত সুস্বাদু এবং গুণগতভাবে উৎকৃষ্ট।
  • মুরগির তুলনায় কোয়েলের দেহের মাংসের ওজন আনুপাতিকহারে বেশি।
  • কোয়েলের বেঁচে থাকার হার মুরগির তুলনায় বেশি। কেননা এদের রোগব্যাধি খুব কম এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও অন্যান্য পোল্ট্রির তুলনায় বেশি।
  • কোয়েল পালনে খাবারবাবদ খরচ অনেক কম লাগে।
  • কোয়েলের দৈহিক ওজনের তুলনায় ডিমের শতকরা ওজন বেশি।
  • ডিমে কোলেস্টেরল কম এবং প্রোটিনের ভাগ বেশি। তাই ডিমের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
  • অল্প পুঁজিতে সারা বছর কোয়েল পালন করা যায়।
  • কোয়েল পালন করে স্বনির্ভর কর্মসংস্থান তৈরির মাধ্যমে বেকার সমস্যা লাঘব করা যায়।
  • স্বল্প পরিসরে পারিবারিকভাবেও কোয়েল পালন করা যায়।

বাণিজ্যিক কোয়েল পালনঃ

বাণিজ্যিক কোয়েলগুলোকে উদ্দেশ্য অনুযায়ী তিনভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন-

১. লেয়ার কোয়েল (Layer quail)

২. ব্রয়লার কোয়েল (Broil quail)

৩. ব্রিডার কোয়েল (Breeder quail)

১. লেয়ার কোয়েলঃ লেয়ার কোয়েল খামার ডিম উৎপাদনের জন্য পালন করা হয়। সাধারণত ৬-৭ সপ্তাহ বয়স থেকে জাপানী কোয়েলী এবং ৮-১০ সপ্তাহ বয়স থেকে ববহোয়াইট কোয়েলী ডিম পাড়া শুরু করে। ব্যবস্থাপনা সঠিক হলে প্রতিটি জাপানী কোয়েলী বছরে ২৫০-৩০০টি এবং ববহোয়াইট কোয়েলী ১৫০-২০০টি ডিম পেড়ে থাকে। লেয়ার খামারে সাধারণত ৫৪ সপ্তাহব্যাপী কোয়েলী পালন করা হয়।

২. ব্রয়লার কোয়েলঃ নরম ও সুস্বাদু মাংস উত্পাদনের জন্য কোয়েলী নির্বিশেষে কোয়েলগুলোকে ব্রয়লার কোয়েল বলা যায়। মাংস উৎপাদনের জন্য জন্মের দিন থেকে পাঁচ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত এবং ববহোয়াইট কোয়েলকে ৮ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত পালন করা হয়। এ সময়ের মধ্যে জীবিতাবস্থায় একেকটি পাখির ওজন হয় ১৪০-১৫০ গ্রাম এবং ওগুলো প্রায় ৭৫% খাওয়ার উপযোগী মাংস পাওয়া যায়।

 ৩. ব্রিডার কোয়েলঃ লেয়ার, ব্রয়লার ও শোভাবর্ধনকারী কোয়েলের বাচ্চা ফোটানোর লক্ষ্যে ডিম উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত বাছাই করা প্রজননক্ষম কোয়েল ও কোয়েলীকে ব্রিডার কোয়েল বলা হয়। সাধারণত ৭-৮ সপ্তাহ বয়সের জাপানী কোয়েলী ও ১০ সপ্তাহ বয়সের কোয়েল ব্রিডিং খামারে এনে পালন করা হয়। কোয়েল-কোয়েলীগুলোকে ব্রিডিং খামারে ৩০ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত রাখা হয়। ববহোয়াইট কোয়েল ৮-১০ সপ্তাহ বয়সে প্রজননক্ষম হয়। প্রজননের জন্য কোয়েল ও কোয়েলীর অনুপাত ১:১ অর্থাৎ এদের জোড়ায় পালন করতে হয়।

যেহেতু পোল্ট্রি শিল্পে বা বর্তমান সময়ে বাণিজ্যিক কোয়েলের গুরুত্বই বেশি। তাই এখানে মূলত বাণিজ্যিক কোয়েল সম্পর্কেই আলোচনা করা হয়েছে।

বাণিজ্যিক কোয়েল পালন পদ্ধতি:

আধুনিক পদ্ধতিতে খামার ভিত্তিক কোয়েল পালন করতে পর্যাপ্ত বাসস্থান প্রয়োজন। বাংলাদেশের বেশীরভাগ এলাকা উষ্ণ ও আর্দ্র হওয়ায় উন্মুক্ত গৃহায়ন (Open housing) পদ্ধতিই বেশি প্রচলিত৷ কোয়েল পালনের উদ্দেশ্য ও বয়সভেদে বিভিন্ন ধরণের ঘরের প্রয়োজন হয়। কোয়েল সাধারণত লিটার এবং খাঁচা দুই পদ্ধতিতে পালন করা যায়।

খামারের জন্য স্থান নির্বাচনঃ

কোয়েলের খামার বা কোয়েলারি (Quailary) গড়তে হলে প্রথমেই আসবে স্থান নির্বাচন। কোয়েলারি/খামার এমন জায়গায় স্থাপন করতে হবে যেখানে নিম্নলিখিত সুবিধাগুলো অবশ্যই থাকবে।

  • যানবাহন চলাচল ও যাতায়াতের সুবিধা।
  • আশেপাশে কোন শহর বা বাজার থাকার সুবিধা।
  • পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহের সুবিধা।
  • কোলাহলমুক্ত ও নির্ঝঞ্ছাট পরিবেশ।
  • বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগমুক্ত স্থান।
  • বিপণন সুবিধা।
  • ভবিষ্যত্ খামার সম্প্রাসারণ সুবিধা।
  • দূষিত গ্যাস নির্গমনকারী যেকোন শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে দূরে হতে হবে।
  • বর্জ্য নিষ্কাষন ও ড্রেনের ব্যবস্থা থাকতে হবে।

 কোয়েলের ঘর নির্মাণঃ

কোয়েলের ঘর নির্মাণের ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। যেমন-

  • পাখিদের জন্য আরামদায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করা।
  • প্রাকৃতিক আলো-বাতাস নিশ্চিত করা ও প্রয়োজন মতো তা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রাখা।
  • অতিরিক্ত শীত, গরম বা বৃষ্টি ও স্যাঁতসেঁতে অবস্থা থেকে পাখিদের রক্ষা করা।
  • নির্দিষ্ট দূরত্বে ও প্রয়োজনীয় আকারের ঘর নির্মাণ করা।
  • বিভিন্ন বয়সের কোয়েলের জন্য পৃথক ঘরের ব্যবস্থা করা।
  • ইঁদুর ও অন্যান্য ক্ষতিকারক জন্তুর হাত থেকে এদের রক্ষা করা।
  • রোগ-জীবাণুর প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা।
  • খামারে পাখির মল-মূত্রের কারণে যে কোন দুর্গন্ধ না হয়, সেজন্য আগে থেকেই সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

 ঘরের প্রকারভেদঃ

কোয়েল পালনের উদ্দেশ্যের উপরভিত্তি করে এদের ঘর বিভিন্ন প্রকার হতে পারে, যেমন-

  1. হ্যাচারী ঘর (Hatchery) : এ ধরনের ঘরে ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানো হয়।
  2. ব্রডার ঘর (Brooder House): এখানে সদ্য ফোটা বাচ্চাদের জন্মের পর থেকে ২/৩ (বা অবস্থাভেদে ৩-৪) সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত কৃত্রিমভাবে তাপ প্রদানের মাধ্যমে পালন করা হয়।
  3. গ্রোয়ার ঘর (Grower house) : এখানে ৩-৫ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত বাচ্চা কোয়েলকে পালন করা হয়।
  4. ডিম পাড়া ঘর (Layer House) : এখানে ৬-৬০ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত ডিম উত্পাদনকারী কোয়েলগুলোকে পালন করা হয়।
  5. ব্রয়লার ঘর (Broiler House) : এখানে একদিন থেকে ৫ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত মাংস উত্পাদনকারী কোয়েলগুলোকে পালন করা হয়।

ঘরের লে-আউট/ডিজাইন :

সমতল ভূমিতে কোয়েলের ঘর পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা ও পূর্ব বা দক্ষিণমূখী হওয়া উচিত। অন্যদিকে, পাহাড়ী এলাকায় কখনোই একেবারে চূড়ায় বা চূড়ার কাছাকাছি এবং সামুদ্রিক এলাকায় সমুদ্রের পাড়ে খামার তৈরি করা উচিত নয়।

আকার (Size)ঃ কোয়েল পালনের জন্য আয়তকার ঘর সবচেয়ে উপযোগী। লিটার পদ্ধতিতে কোয়েল পালন করা হলে ঘর অবশ্যই ছোট হওয়া বাঞ্ছনীয়। খাঁচা বা ব্যাটারী (Battery) পদ্ধতির ক্ষেত্রে ঘরের আকার ছোট কিংবা বড় হলেও অসুবিধা নেই। ঘরের দৈর্ঘ্য যাই হোক না কেন প্রস্থ ৪.৫-৯.০ মিটার হওয়া উচিত। সঠিক বায়ু চলাচলের জন্য প্রস্থ ৯.০ মিটারের বেশি হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়।

ছাদ (Roof) : ছাদের ডিজাইন সাধারণ ঘরের প্রস্থ, খামার এলাকার অবস্থা, গৃহায়নের ধরন ইত্যাদির উপর নির্ভর করে। ছাদের ডিজাইন বেশ কয়েক ধরণের হতে পারে। যেমন- (১) শেড টাইপ (Shed type), (২) গ্যাবল টাইপ (Gable type), (৩) প্যাগোডা টাইপ (Pagoda type) ইত্যাদি৷  ছাদ তৈরিতে ঢেউটিন, অ্যাসবেস্টোস, খড় ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে।

দেয়াল (Wall): ঘরের দু’পাশের দেয়াল ২.৫-৩.০ মিটার উঁচু হবে৷ দেয়ালের নিচের অংশ (২.৫-৩.০ মিটার পর্যন্ত) ইট বা নিরেট (solid) কোন বস্তু দিয়ে তৈরি করতে হবে৷ অ্যাঙ্গেল লোহা বা লোহার পাইপের উপর শক্ত তারজালি দিয়ে দেয়ালের উপরের অংশ তৈরি করা যায়।

মেঝো (Floor) : ঘরের মেঝে মাটির লেভেল থেকে অন্তত তিন মিটার উঁচু হওয়া উচিত৷ সিমেন্ট ও কংক্রীট দিয়ে তৈরি পাকা মেঝে সবচেয়ে ভালো।

দরজা (Door): ঘরের কমপক্ষে দু’টি দরজা থাকবে, সেগুলো ১.২ মিটার চওড়া ও ২.০ মিটার উঁচু হবে৷ দরজা অবশ্যই কাজের পথের (Service rood/working pathway) সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে, যাতে অনায়াসে খামার ও অন্যান্য দ্রব্য সামগ্রী আনা-নেয়া করা যায়।

বায়ু চলাচল ব্যবস্থা (Ventilation) : আধা উন্মুক্ত ঘরে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে বায়ু চলাচল করে। ঘর ছোট হলে দেয়ালের শেষ প্রান্তে একটি এগজস্ট পাখা (Exhaust fan) এবং বড় হলে প্রয়োজন অনুযায়ী একাধিক পাখা এমনভাবে স্থাপন করতে হবে যেন বাতাস ঘরের ঠিক মাঝখানে আসে।

লাইট (Light) : কোয়েলের ঘরে বৈদ্যুতিক বাল্বের পয়েন্টগুলো মেঝে থেকে অন্তত ২.০ মিটার উঁচুতে হবে। লক্ষ রাখতে হবে যেন এগুলো ঢিলা হয়ে ঝুলে না থাকে।

খামারের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও উপকরণঃ

কোয়েলের খামার পরিচালনার জন্য বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও উপকরণের প্রয়োজন হয় নিম্নে এগুলোর একটি তালিকা প্রদান করা হলো। যথা-

১. ব্রুডার হোভার

২. হিটার/স্টোভ

৩. প্লাস্টিকের টিক ফিড ট্রে

৪. খাবার পাত্র

৫. পানির পাত্র

৬. ডিম পাড়ার বাক্স (লিটার পদ্ধতির ক্ষেত্রে)

৭. ইলেকট্রিক বাল্ব

৮. নিক্তি বা ব্যালান্স

৯. বালতি, বেলচা, কোদাল, বাটি, চাকু, ঝুড়ি, আঁচড়া, টুলি ইত্যাদি।

১০. খাঁচাতে পালন করলে প্রয়োজনীয় খাঁচা

১১. বাঁশ, কাঠ, ঢেউটিন, পলিথিন বা ত্রিপল ইত্যাদি।

১২. থার্মোমিটার, হাইপ্রোমিটার

১৩. লিটার সামগ্রী (তুষ, কাঠের গুঁড়া ইত্যাদি)

১৪. ব্যাটারী ব্রুডার

১৫. ডিম পাড়ার বাসা

নিম্নে গুরুত্বপূর্ণ কিছু যন্ত্রপাতি ও উপকরণের বর্ণনা দেওয়া হলোঃ

খাবার পাত্র (Feeder)ঃ

একটি উৎকৃষ্টমানের কোয়েলের খাবার পাত্রের বৈশিষ্ট হবে-

(ক) একটি খাদ্য দিয়ে সহজেয়ই পূর্ণ করা যাবে।

(খ) পরিস্কার করা সহজ হবে।

পানির পাত্র (Water or drunker) :

খাঁচা বা লিটার যে পদ্ধতিতেই পালন করা হোক না কেন একটি উৎকৃষ্টমানের কোয়েলর পানির পাত্রের বৈশিষ্ট হবে নিম্নরূপ-

(ক) এটি থেকে পাখি পরিচ্ছন্ন পানির সরবরাহ পাবে।

(খ) এটি পানি পানের উপযোগী হবে।

(গ) পরিস্কার করা সহজ হবে।

(ঘ) টেকসই ও দামে সস্তা হবে৷।

ব্রুডার হোভার ও বাচ্চা বেস্টনী (Brooder hover & chick quard) :

একদিন বয়সী বাচ্চাগুলোকে সাধারণত ব্রুডারের সাহায্যেই বাঁচিয়ে তোলা ও বড় করা হয়। ব্রুডারে একটি তাপের উৎস থাকে, যেমন-বৈদ্যুতিক হিটার, বৈদ্যুতিক বাল্ব, কেরোসিন বাতি, তুষ-কাঠ বা কয়লার বাতি, হ্যাজাক লাইট বা ইনফ্রারেড বাল্ব৷। তবে ইনফ্রারেড বাল্বই হলো সবচেয়ে বিজ্ঞানসম্মত।

ব্রডারে একটি ছাতায় যত অংশ থাকে যা হোভার নামে পরিচিত৷ এটি বর্গাকার, আয়তকার, ষড়ভুজাকৃতি বা গোলাকার হতে পারে। ব্রডারের হোভারটি জি.আই.পাত, বাঁশ বা কাঠ দিয়ে তৈরি করা যায়। বাচ্চারা যাতে ব্রুডারের ভিতর সঠিকভাবে খাদ্য ও পানি গ্রহণ করতে পারে এবং এক জায়গাতে থাকতে পারে। সেজন্য হোভারের চারিদিকে ১৫ সেমি. দূরত্বে গোলাকার একটি বেষ্টনী দেওয়া হয় যাকে বলা হয় চিক গার্ড। এটি টিন, চাটাই, হার্ডবোর্ড বা মোটা কাগজ দিয়ে তৈরি করা যায়।

ডিম পাড়ার বাসা (Laying nest)ঃ ডিম পাড়ার বাসা প্রতিটি পাখির জন্য ব্যক্তিগত এবং একসঙ্গেও হতে পারে, ব্যক্তিগত বাসার ক্ষেত্রে ১৫ সেমি. চওড়া, ২০ সেমি. গভীর ও ২০ সেমি উচ্চতা বিশিষ্ট বাক্সের ব্যবস্খা করতে হবে। আর যৌথ বাসার ক্ষেত্রে ১.০ মিটার লম্বা, ২০ সেমি. গভীর ও ২০ সেমি উচ্চতা বিশিষ্ট বাক্সের ব্যবস্থা করতে হবে।

কোয়েলের খাঁচা তৈরীঃ
কোয়েল পালনে খাঁচা বা ব্যাটারী পদ্ধতি সহজ, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত। অল্প জায়গায় অধিক সংখ্যায় কোয়েল পালন করতে ব্যাটারী পদ্ধতির জুড়ি নেই। বিভিন্ন বয়সের কোয়েল পালনের জন্য বিভিন্ন প্রকার খাঁচা, যেমন- ব্রডার খাঁচা, বিয়ারিং খাঁচা, লেয়ার খাঁচা, ব্রিডার খাঁচা ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়।

ব্যাটারি ব্রুডার (Battery Brooder) : একদিন বয়স থেকে ২-৩ বা অবস্থাভেদে ৩-৪ সপ্তাহ পর্যন্ত নিরাপদে ও স্বাস্থ্যসম্মতভাবে লালন-পালনের জন্য ব্যাটারি ব্রুডারই উত্কৃষ্ট৷ ব্যাটারি ব্রুডার ইউনিটের প্রতিটি তলা (tier) দৈর্ঘ্য ১৬০ সেমি., প্রস্থ ৮০ সেমি. এবং উচ্চতায় ২৫ সেমি. হবে।

বিয়ারিং খাঁচা (Rearing cage) : তিন/চার সপ্তাহ বয়স থেকে ডিম পাড়ার পূর্ব পর্যন্ত অর্থাত্ ৫-৬ (বা অবস্থাভেদে ৪-৫) সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত কোয়েলকে গ্রোয়ার ঘরে বা বিয়ারিং খাঁচায় পালন করা হয়।

বয়ষ্ক কোয়েলের খাঁচা (Cages for adult quails) : কোয়েল যখন ডিম পাড়ার উপযোগী হয় তখন এদের বিয়ারিং খাঁচা থেকে লেয়িং খাঁচায় স্থানান্তর করা হয়।

লিটার ও লিটার ব্যবস্থাপনাঃ

লিটারঃ পোল্ট্রির ঘরে শস্যা হিসেবে ব্যবহৃত বিভিন্ন বস্তুকে লিটার বলে৷ এক কথায় বাসস্থানকে আরামদায়ক করার জন্য কোয়েলের ঘরে যে বিছানা ব্যবহার করা হয় তাই লিটার।

লিটারের উপকরণঃ লিটার হিসেবে সাধারণত ধানের তুষ, করাতের গুঁড়া, ধান বা গমের শুকনো খড়ের টুকরো, কাঠের ছিলকা, বাদামের খোসার গুঁড়া ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। এগুলো এককভাবে ব্যবহার না করে সাধারণত কয়েকটি একসঙ্গে মিশিয়ে ব্যবহার করা ভালো।

 লিটার প্রস্তুতঃ

  • শুরুতে ৫ সেমি.পুরু লিটার সামগ্রী পরিস্কার মেঝেতে ছড়িয়ে দিতে হবে।
  • ধীরে ধীরে আরো লিটার সামগ্রী যোগ করে ৪-৫ সপ্তাহের মধ্যে এই পুরুত্ব ১০ সেমি.-এ উন্নীত করতে হবে।
  • ব্যাটারি ব্রুডারে পালিত বাচ্চার ক্ষেত্রে শুরুতেই ১০ সে.মি. পুরু লিটার ব্যবহার করতে হবে।
  • স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করতে তাজা লিটার সামগ্রী বিছানোর পরপরই কোনো উৎকৃষ্টমানের ও  কার্যকরী জীবাণুনাশক স্প্রে করতে হবে। তবে বাচ্চা নামানোর ৯৬ ঘণ্টা  পূর্বেই এ কাজ শেষ করতে হবে।

লিটারের পরিচর্যাঃ

  • উৎকৃষ্ট লিটারের আর্দ্রতা সব সময় ২৫-৩০% হওয়া উচিত।
  • অতিরিক্ত আর্দ্রতা দূর করার ব্যবস্থা করতে হবে।
  • লিটারের স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ রক্ষার জন্য ঘনঘন লিটার উল্টেপাল্টে দিতে হবে।
  • ঘরে বায়ু চলাচলের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখতে হবে।
  • বাতাসে আর্দ্রতা বেড়ে গেলে ৪-৫ কেজি/১০ ঘনমিটার জায়গা (ফ্লোর এরিয়া) হিসেবে লিটারে কালিচুন (স্ল্যাকড লাইম) যোগ করতে হবে।
  • পানির পাত্রের চারদিকের ভিজা লিটার বদলে তাজা লিটার সামগ্রী দিতে হবে।
  • অতিরিক্ত গরমে লিটারের আর্দ্রতা কমে গেলে স্প্রে’র মাধ্যমে পানি ছিটিয়ে আর্দ্রতা ঠিক রাখতে হবে।

ব্রুডিং (Brooding) :

ছোট বাচ্চাদের তা বা তাপ দেয়াকে ব্রুডিং বলে। ব্রুডিং দু’প্রকার যথা-

(ক) প্রাকৃতিক ব্রুডিং (Natural brooding) ও

(খ) কৃত্রিম ব্রুডিং (Artificial brooding)

প্রাকৃতিক ব্রুডিং: এ পদ্ধতিতে প্রাকৃতিভাবে ছোট আকারের দেশী মুরগির (Foster Hen) সাহায্যে বাচ্চাকে তাপ দেওয়া হয়৷ এটি অল্প সংখ্যক বাচ্চার জন্য একটি অত্যন্ত ভালো পদ্ধতি।

কৃত্রিম ব্রুডিং: মুরগীর সাহায্য ছাড়া কৃত্রিম পদ্ধতিতে ব্রুডারের মাধ্যমে বাচ্চা তাপ দেওয়াকে কৃত্রিম ব্রুডিং বলে৷ কৃত্রিম ব্রুডিং এর মধ্যে রয়েছে লিটার, ব্রুডিং, ঠাণ্ডা ব্রুডিং, উষ্ণ ব্রুডিং, ব্যাটারি বা খাঁচা ব্রুডিং ইত্যাদি।

ব্রুডিং-এর মূলনীতি (Brooding principles) : লেয়ার বা ব্রয়লার সব ধরণের কোয়েলের ক্ষেত্রে ব্রুডিং ব্যবস্থা একই রকম৷ ব্রুডিংকালে নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর প্রতি যত্মশীল হতে হবে। যেমন-

১. সঠিক তাপমাত্রা

২. পর্যাপ্ত আলো

৩. বায়ু চলাজল ব্যবস্থা

৪. বাচ্চার ঘনত্ব (সংখ্যা)

৫. খাদ্য ও পানি ব্যবস্থাপনা

৬. স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ ইত্যাদি।

ব্রুডারে বাচ্চা তোলার পূর্বে করণীয়ঃ

  • খামারে বাচ্চা তোলার অন্তত দু’সপ্তাহ আগে ব্রুডার ঘর ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
  • ঘরে বিশুদ্ধ বাতাস প্রবেশের জন্য ভেনিটলেটর ও দরজাগুলো খুলে রাখতে হবে।
  • বাচ্চা আসার দু’দিন আগে সব যন্ত্রপাতি চালু করতে হবে।
  • খামার পাত্রগুলো পুরো ব্রুডিং এলাকায় সমান দূরত্বে স্থাপন করতে হবে।
  • পানির পাত্রগুলো খাবার পাত্রগুলোর মাঝখানে রাখতে হবে।
  • বাচ্চা বেষ্টনী সঠিকভাবে দিতে হবে।
  • হোভারের নিচে তাপ সব জায়গায় সমানভাবে পৌঁছাচ্ছে কিনা খেয়াল রাখতে হবে।
  • ব্রুডারে বাচ্চা দেয়ার অল্প কিছুক্ষণ আগে কাগজ বা কার্ডবোর্ড বিছিয়ে তার উপর খাবার ছিটিয়ে দিতে হবে।
  • এদের সামনে ধকল-প্রতিরোধী উপাদান, যেমন-৮% গ্লুকোজ মিশ্রিত পানি, ভিটামিন সি ইত্যাদি রাখতে হবে।

ব্রুডারে বাচ্চা তোলার সঙ্গে সঙ্গে করণীয়ঃ

  • ব্রুডারে বাচ্চা আসার সঙ্গে সঙ্গেই এদের ব্রুডারের হোভারের নিচে সমভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে।
  • ধকল-প্রতিরোধী উপাদান (গ্লুকোজ মিশ্রিত পানি, ভিটামিন ‘সি’ ইত্যাদি) মিশ্রিত পানি এদের সামনে দিতে হবে।
  • ব্রুডারে বাচ্চা রাতের আগেই তুলতে হবে, এতে বাচ্চা পর্যবেক্ষণের যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে।
  • বাচ্চাদের বৃদ্ধি সঠিক হচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
  • আবহাওয়া ও দৈহিক বৃদ্ধির উপর নির্ভর করে এদের বিয়ারিং পর্বে পালনের ঘর বা কেইজে স্থানান্তর করতে হবে।
  • তিন সপ্তাহ বয়সে কোয়েল-কোয়েলী আলাদা করে ফেলতে হবে।

কৃত্রিম ব্রুডিং এর প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিঃ কৃত্রিম ব্রুডিংয়ের জন্য নিম্নলিখিত যন্ত্রগুলোর প্রয়োজন হবে। যথা-

১. ব্রুডার বা বাচ্চা তাপানোর যন্ত্র৷

২. চিক গার্ড/ব্রুডার বা বাচ্চা বেষ্টনী

৩. ব্রুডার চুল্লি বা হিটার

৪. হোভার

৫. লিটার বা বিছানা

৬. থার্মমিটার

৭. হাইগ্রোমিটার

৮. খাদ্য ও পানির পাত্র

কোয়েলের খাদ্য

কোয়েল খামারের মোট খরচের ৬০-৭০% ই খাদ বাবদ হয়৷ অন্যান্য পোল্ট্রির মতো কোয়েলের খাদ্য তালিকায়ও ছয়টি পুষ্টি উপাদান (Feed nutrients), যেমন পানি (Water), শর্করা (Carbohydrates), স্নেহ পদার্থ (Lipids), আমিষ (Proteins), ভিটামিন (Vitamins), ও খনিজ পদার্থ (Minerals) থাকতে হবে। কোয়েল পালন থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণে সবগুলো পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করতে হবে।

এখানে এদেশে প্রচলিত জাপানি কোয়েলর একটি খাদ্য তালিকা দেখানো হলোঃ

সারণী-১

এদেশে প্রচলিত জাপানী কোয়েলের খাদ্য তালিকা

খাদ্যোপাদান প্রারম্ভিত রেশন

(০-৩ সপ্তাহ)

বৃদ্ধির রেশন

(৪-৫ সপ্তাহ)

লেয়ার ব্রিডার রেশন

(০-৩ সপ্তাহ)

 গম ভাঙ্গা ৫০.০০ ৫০.০০ ৫০.০০
 তিলের খৈল ২৩.০০ ২৩.০০ ২৩.০০
 শুঁককি মাছের গুঁড়া ১৮.০০ ১৫.০০ ১২.০০
 চালের মিহি কুঁড়া ৬.০০ ৮.০০ ৯.০০
 ঝিনুক চূর্ণ ২.৪০ ৩.৪০ ৫.৩০
 খাদ্য লবণ ০.৩০ ০.৩০ ০.৪০
 ভিটামিন-মিনারেল প্রিমিক্স

যেমন-এমবাভিট)

০.৩০ (জি.এম) ০.৩০ (জি.এম) ০.৩০ (এল.
 সর্বমোট ১০০.০০ ১০০.০০ ১০০.০০

উৎস: ডা. আ ন ম আমিনুর রহমান (১৯৯৬), কোয়েল পালন (প্রথম সংস্করণ)৷

খাদ্য ব্যবস্থাপনাঃ কোয়েল পালন থেকে কাঙ্খিত উৎপাদন পেতে হলে খাদ্য ব্যবস্থাপনা সঠিক হতে হবে। নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।

  • প্রতিটি পাখির জন্য পর্যাপ্ত খাত্য ও খাদ্যপাত্র সরবরাহ করতে হবে৷
  • বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ সুষম খাদ্য সরবরাহ করতে হবে৷
  • নিম্নমানের ফাঙ্গাসপড়া ভেজাল খাদ্য খাওয়ানো উচিত নয়৷
  • খাদ্য গুঁড়ো করে বিশেষতঃ শুঁটকি মাছ, ঝিনুক, গম ইত্যাদি) সরবরাহ করা উচিত নয়৷
  • একবার খাবার সরবরাহ করলে তা পুরোপুরি শেষ না হওয়া পর্যন্ত আবার সরবরাহ করা যাবে না৷
  • দৈনিক তিনবার, যেমন-সকাল ৬টা, দুপুর ১২-১টা এবং সন্ধ্যা ৭টার দিকে খাবার দেয়া উচিত৷
  • খাবারপত্র কখনোই পুরোপুরিভাবে খাদ্য দিয়ে পূর্ণ করা যাবে না৷
  • খাদ্যপাত্রগুলো নিয়মিত জীবাণুনাশক দিয়ে পরিস্কার করতে হবে৷

কোয়েলর খাদ্য গ্রহণের পরিমাণঃ

কোয়েলের খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ এদের বয়স, ধরন (উদ্দেশ্য), মৌসুম (শীত, গ্রীষ্ম বা বর্ষাকাল) এবং খাদ্য বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের (প্রধানত শক্তি ও আমিষ) ঘনত্ব ইত্যাদির উপর নির্ভর করে৷ জন্মের দিন থেকে ৫ সপ্তাহ পর্যন্ত বাচ্চাপ্রতি মাত্র ৪০০ গ্রাম খাদ্যের প্রয়োজন হয়৷ ছয় সপ্তাহ বয়স থেকে প্রতিটি পাখি দৈনিক ২০-২৫ গ্রাম করে খাদ্য খায়৷ গড়ে প্রতিটি প্রাপ্ত বয়স্ক কোয়েলের জন্য বছরে মাত্র ৮ কেজি খাদ্যের প্রয়োজন হয়৷ ডিমপাড়ার পূর্বে প্রতিটি কোয়েলী থেকে এক গ্রাম ডিম উত্পাদনের জন্য প্রায় ৩.০ গ্রাম খাদ্য সরবরাহ করতে হয়৷

খাদ্য সংরক্ষণঃ

অন্যান্য প্রাণীর মতো কোয়েলের খাদ্য ও সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে৷ নিম্নলিখিত বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে। যেমন-

  • খাদ্যে ছত্রাক ও অন্যান্য জীবাণুর দূষণ যেন না ঘটে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে৷
  • খাদ্যদ্রব্য ব্যবহারের পূর্বে পরীক্ষা করে, উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ দেখে ব্যবহার করতে হবে৷ খাদ্য শুষ্ক ও পরিস্কার জায়গায় রাখতে হবে৷
  • ড্রাম বা টিনে রাখলে ভালভাবে পাত্রের মুখ বন্ধ করতে হবে, আর বস্তায় রাখলে বস্তার মুখ ভালোভাবে বন্ধ করতে হবে৷
  • খাদ্যে যেন আফলাটক্সিন জন্মাতে না পারে সেজন্য প্রয়োজনে প্রতি টন খাদ্যে ২ কেজি মাত্রায় ক্যালসিয়াম প্রোপিওনেট যোগ করলে ভাল হয়৷
  • ৮ সপ্তাহের বেশি সংরক্ষণ করলে খাদ্যের ভিটামিন নষ্ট হয়ে যায় ও খাদ্য পঁচে যেতে পারে, তাই খাদ্য সংরক্ষণে সাবধান হতে হবে৷

পানি ব্যবস্থাপনাঃ

যেকোন প্রাণীর ক্ষেত্রেই পানির গুরুত্ব অপরিসীম৷ খাদ্য বিপাক, দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, রক্তে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান ও রাসায়নিক দ্রব্য পরিবহন প্রভৃতি এই পানির মাধ্যমেই ঘটে বাচ্চা কোয়েলের পানির প্রয়োজনীয়তা খাদ্যের পরিমাণ ও বয়সের সাথে বদলাতে থাকে৷ সাধারণত দেখা যায় ১২-১৫, ১৯-২২ ও ২৬-২৯ দিন বয়সে এরা দেহের ওজনের যথাক্রমে ৪.২, ৩.১ ও ২.৭ গুণ পানি গ্রহণ করে৷ এরপর থেকে প্রতিগ্রাম ওজন বৃদ্ধির জন্য ২ গ্রাম হারে পানি গ্রহণ করে৷ তবে, সাধারণভাবে যে-কোন বয়সের কোয়েল শুষ্ক খাবারের দ্বিগুণ পানি গ্রহণ করে থাকে৷ নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর প্রতি সবসময় দৃষ্টি রাখতে হবে৷ যেমন-

  • পাখিকে সব সময় পরিস্কার ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে৷
  • প্রতিটি পাখির জন্য পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি ও পাখির পাত্র সরবরাহ করতে হবে৷
  • তিনবেলা খাবার সরবরাহ করার সময় বিশুদ্ধ পানিও সরবরাহ করতে হবে৷
  • শুঁটকি মাছ পড়ে বা অন্য কোনভাবে পানির পাত্র যেন নোংরা না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে৷
  • পানির পাত্রগুলো দৈনিক কমপক্ষে দু’বার পরিষ্কার করতে হবে৷
  • পানির পাত্র পুরোপুরিভাবে পূর্ণ করা উচিত নয়৷ এতে পানি পড়ে লিটার স্যাঁতসেঁতে হয়ে যায়৷

তাপমাত্রা, আলো ও আর্দ্রতাঃ

তাপমাত্রঃ কোয়েলের ঘরের তাপমাত্রা ২১-২২° সে.-এ (৬৯.৮° – ৭১.৬° ফা.) স্থির রাখতে হয়৷ এর থেকে বেশি তাপমাত্রায় এরা হিট স্ট্রেস (Heat stress) বা তাপ পীড়নে ভোগে।

আলোঃ কোয়েলীর ডিম উত্পাদন আলোর উপর যথেষ্ট নির্ভরশীল৷ তাই পর্যাপ্ত সংখ্যায় ডিম পেতে হলে কোয়েলীর ঘরে নবম সপ্তাহ থেকে দৈনিক ১৬ ঘন্টা আলোর ব্যবস্থা (দিনের আলোসহ) থাকতে হবে৷ সপ্তাহে ১৩ ঘন্টা আলোর ব্যবস্থা করতে হবে৷ সপ্তম, অষ্টম ও নবম সপ্তাহে সপ্তাহপ্রতি একঘন্টা হিসেবে বাড়িয়ে তা যথাক্রমে ১৪, ১৫ ও ১৬ ঘন্টায় বৃদ্ধি করতে হবে৷ উল্লেখ্য, একটি ৪০ ওয়াটের বাল্ব দিয়ে ১০.০ বর্গমিটার জায়গা আলোকিত করা যায়৷ নীল বর্ণের আলোর তুলনায় লাল বর্ণের আলোয় কোয়েলর ডিম উৎপাদন  বেশি বৃদ্ধি পায়৷

আর্দ্রতাঃ কোয়েল ৪০-৭০% আপেক্ষিক আর্দ্রতায় সহজেই নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারে৷ তবে, ঘরের আপেক্ষিকত আর্দ্রতা ৫৫-৬০% হলে ভাল হয়৷ আপেক্ষিক আর্দ্রতা বেশি হলে এদের পালক সিক্ত হবে, শ্বাসীয় সমস্যা দেখা দেবে ও ছত্রাকের আক্রমণ বৃদ্ধি পাবে৷ আপেক্ষিক আর্দ্রতা কম হলে এদের পালক রুক্ষ্ম হয়ে যাবে৷

সারণী-২-এ বয়সভেদে লেয়ার কোয়েলের জন্য বরাদ্দকৃত তাপমাত্রা, আলো, আপেক্ষিক আর্দ্রতা, জায়গা প্রভৃতি দেখানো হলো-

বয়স

(সপ্তাহ)

তাপমাত্রা (সে./ফা.) আলো

(ঘন্টা)

আপেক্ষিক

আর্দ্রতা

(%)

ফ্লোর স্প্রেস খাবার জায়গা

(সেমি.)

পানির জায়গা

(সেমি.)

প্রথম ৩৫° সে. (৯৫° ফা.) ২৪ ৬০-৬৫ ৭৫ ২.০ ১.০
দ্বিতীয় ৩০° সে. (৮৬° ফা.) ২৪ ৬০-৬৫ ৮৫ ২.০ ১.০
তৃতীয় ২৫° সে. (৭৭° ফা.) ১২ ৬০-৬৫ ১০০ ২.০ ১.০
চতুর্থ ২১-২২° সে.

(৬৯.৮-৭১.৬° ফা.)

১২ ৬০-৬৫ ১১৫ ২.৫ ১.৫
পঞ্চম ,, ১২ ৫৫-৬০ ১৩০ ২.৫ ১.৫
ষষ্ঠ ,, ১৩ ৫৫-৬০ ১৫০ ৩.০ ২.০
সপ্তম ,, ১৪ ৫৫-৬০ ১৬০ ৩.০ ২.০
অষ্টম ,, ১৫ ৫৫-৬০ ১৭০ ৩.০ ২.০
নমব ,, ১৬ ৫৫-৬০ ১৮০-২০০ ৩.০ ২.০
বাকী সময় ,, ১৬ ৫৫-৬০ ১৮০-২০০ ৩.০ ২.

উৎস : কোয়েল পালন, ডা: আ ন ম আমিনুর রহমান ।

খামার ব্যবস্থাপনাঃ

কোয়েল খামার থেকে পর্যাপ্ত উত্পাদন পেতে হলে প্রতিটি খামারিকে অবশ্যই খামার ব্যবস্থাপনার খুঁটিনাটি বিষয়গুলোর দিকে নজর দিতে হবে৷ ছোটখাট যে-কোন অবহেলা বা ভুল কাজকর্ম কোয়েল খামারের লোকসানের জন্য যথেষ্ট। নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর প্রতি খামারিদেরকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে। যেমন-

  1. পীড়ন বা স্ট্রেস (Stress) দূরীকরণঃ কোয়েল থেকে ভালো উৎপাদন  পেতে হলে অবশ্যই আরামপ্রদ পরিবেশে  এদের লালন পালন করতে হবে৷ পীড়নের (Stress) ফলে উত্পাদন মারাত্মকভাবে হ্রাস পায় এবং কোন কোন সময় মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে৷
  2. খাদ্য ও পানি ব্যবস্থাপনাঃ কোয়েলের খাদ্য ও পানি ব্যবস্থাপনা সঠিক হতে হবে৷ প্রতিটি পাখির জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য ও পানির জায়গা এবং পাত্র থাকলে এরা খাদ্য ও পানি গ্রহণে স্বাচ্ছন্দবোধ করবে৷
  3. ডিম সংগ্রহঃ দিনে অন্তত দু’তিনবার ডিম সংগ্রহ করা উচিত৷ প্রথবার সন্ধ্যা ৬:০০-৬:৩০ টায় এবং দ্বিতীয়বার রাত ৯.০০-৯.৩০ টায়৷
  4. ডিম সংরক্ষণঃ ডিম সংগ্রহের পরপরই তা সংরক্ষণ করতে হবে৷ সংরক্ষণ ঘরের তাপমাত্রা ও আপেক্ষিক আর্দ্রতা যথাক্রমে ১২.৮° -১৫.৫° সে. (৫৫.০° – ৫৯.৯° ফা.) ও ৭৫-৮০% হওয়া উচিত৷
  5. সেক্সিং (Sexing)ঃ পারিবারিক বা বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত খামারে উত্পাদিত ডিম থেকে হ্যাচারিতে বাচ্চা ফোটানোর পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কোয়েল/কোয়েলী (স্ত্রী/পুরুষ) নির্ণয় বা সেক্সিং (Sexing) করা প্রয়োজন৷
  6. ঠোঁট কাটা বা ডিবিকিং (Debeaking): কোয়েল ব্যবস্থাপনার মধ্যে ডিবিকিং একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ডিবিকিং হল ঠোঁটের একটি নির্দিষ্ট অংশ কেটে বাদ দেয়া৷ পায়ের আঙুলের নখের মৃত অংশ কেটে বাদ দেয়া অর্থাত্ নগ কাটা হলো ডিটোরিং (Detoeing)।
  7. কোয়েল ধরাঃ কোয়েলকে শুধু বুড়ো আঙ্গুল ও তর্জনীর সাহায্যে আলতোভাবে ধরতে হবে৷ প্রাপ্ত বয়স্ক কোয়েল ধরার ক্ষেত্রে একটি ছোট নেট বা ক্যাচিং বক্স ব্যবহার করা যেতে পারে৷

খামারের জীব নিরাপত্তা (Biosecurity) :

স্বাস্থ্য ও সেনিকেটশন ব্যবস্থাঃ সঠিক স্বাস্থ্য ও সেনিকেটশন ব্যবস্থা কোয়েল খামারের সাফল্যে পূর্বশর্ত।

  • বিভিন্ন বয়সের কোয়েল আদালাভাবে বা ভিন্ন ভিন্ন ঘরে পালন করতে হবে৷
  • রোগমুক্ত, স্বাস্থ্যবান, উচ্চ সংশীয় এবং বিশুদ্ধ হ্যাচারী থেকে বাচ্চা সংগ্রহ করতে হবে৷
  • রোগাক্রান্ত ও স্বাস্থ্যহীন পাখি সুস্থ পাখিদের থেকে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি পৃথক করে ফেলতে হবে৷
  • অন্য প্রজাতির পশুপাখির খামার থেকে কোয়েলের খামার দূরত্ব স্থাপন করতে হবে৷
  • প্রয়োজনীয় পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, তাপমাত্রা, আপেক্ষিক আর্দ্রতা ও বিশুদ্ধ বাতাসের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে৷
  • নতুন ব্যাচ খামারে প্রবেশ করানোর পূর্বে অবশ্যই ঘর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত করতে হবে৷
  • ইঁদুর ও অন্যান্য প্রাণী বা রডেন্ট (Rodents), কীটপতঙ্গ ও পশুপাখির হাত থেকে খামারমুক্ত রাখতে হবে৷
  • দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে৷
  • মৃত কোয়েল ও বর্জ্য পদার্থ দ্রুত অপসারণের ব্যবস্থা করতে হবে৷

জীবাণুনাশকের ব্যবহারঃ কোয়েল খামারে স্বাস্থসম্মত ও জীবাণুমুক্ত পরিবেশ রক্ষায় জীবাণুনাশকের (Disinfectant) ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ বিভিন্ন পরীক্ষায় দেখা গেছে, কোন একটি জীবাণুনাশক এককভাবে কার্যকরী হয় না৷ তাই যেকোন একটি যেমন তাপ (Heat) সূর্যরশ্মি (Sunlight), কোন-টার- ডেরিভেটিভস (Coal-tas-derivatives), ক্লোরিন (Chorine), ফরমাল ডিহাইড (formaldehyde), তুঁতে (Copper sulphate) ইত্যাদি পদ্ধতিতে জাবীণুনাশক ব্যবহার করতে হবে৷

অধিক উৎপাদনে করণীয়/পরমার্শঃ

কোয়েল/কোয়েলী থেকে সঠিক উৎপাদন পেতে হলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর দিকে খেয়াল রাখতে হবে-

ক. উন্নত কৌলিকগুণসম্পন্ন স্ট্রেইনের সুস্থ পাখি সংগ্রহ করা৷

খ. কোন নামকরা ও প্রতিষ্ঠিত হ্যাচারী থেকে বাচ্চা/পাখি সংগ্রহ করা৷

গ. জন্মের ১ম দিন থেকেই পাচ্চাগুলোর জন্য সঠিক তাপমাত্রা, আলো, খাদ্য ও পানির ব্যবস্থা করা৷ ঘ. লেয়ার পাখিদের জন্য নিয়মিত ফর্মুলা মতো খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও দৈনিক ১৬ ঘন্টা আলোর ব্যবস্থা করা৷

ঙ. পাখির ঘরে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা করা৷

চ. ঘর ও খাঁচা সর্বদা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত রাখা৷

ছ. পাখিদের কোন প্রকার বিরক্ত না করা৷

জ. সঠিক নিয়মে ডিবিকিং করা৷

ঝ. অসুস্থ পাখি দ্রুত পৃথক করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা৷

বাচ্চা স্থানান্তরের জন্য বিবেচ্য বিষয়ঃ

হ্যাচারীতে বাচ্চা উত্পাদনের পর সেখান থেকে এজেন্টদের কাছে এবং সেখান থেকে খামারির ব্রুডিং ঘর, তারপর গ্রোয়ার বা লেয়ার ঘর/কেইজে স্থানান্তর করতে হয়৷ একস্থান থেকে আরেক স্থানে বাচ্চা স্থানান্তরের সময় এই বিষয়গুলির প্রতি খেয়াল রাখতে হবে৷ যথা-

  • পরিবহণ বা যানবাহনের ভিতর ও বাহিরে ভালভাবে জীবাণুনাশক দিয়ে পরিচ্ছন্ন করে নিতে হবে৷
  • বাক্সগুলো তিন স্তরের বেশি উঁচু করা যাবে না৷
  • বাক্সের দুটো স্তরের মধ্যে ১০ সেমি. দূরত্ব বজায় রাখতে হবে৷
  • বাচ্চার জন্য যথেষ্ট নির্মল বাতাসের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে৷
  • স্থানান্তরের সময় তিন ঘন্টার বেশি হলে তখন গ্লুকোজ মিশ্রিত পানি, কিছু তরমুজের বা ফুটানো সবুজ পেপের টুকরা বাক্সের ভিতর বিছিয়ে দিতে হবে, এগুলো বাচ্চাকে পানিশূন্যতা থেকে রক্ষা করবে৷

ব্যবহৃত শেডে/কোয়েলের ঘরে বাচ্চা উঠানোর পূর্বে করণীয়ঃ

  • পূর্বে ব্যবহৃত সকল লিটার, খাবার পাত্র, পানির পাত্র এবং ব্রুডার অবশ্যই শেড হতে সরাতে হবে এবং ভালোভাবে পরিস্কার পরিচ্চন্ন করতে হবে৷
  • লিটার সরানোর পর কোয়েলের ঘর শলার ঝাড়ু এবং ফুল ঝাড়ু দিয়ে পরিস্কার করতে হবে তারপর মেঝে, সিলিং এবং দেয়াল ও ছাদের ময়লা আবর্জনা সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে দিতে হবে৷
  • মেঝে ও দেয়াল পরিস্কার করার পর পানির সাথে প্রস্তুতকারকের নির্দেশ অনুযায়ী জীবাণুনাশক ঔষধ মিশিয়ে মেঝে, সিলিং এবং দেয়াল পরিস্কার করতে হবে৷
  • পরিস্কার করণ এবং জীবাণুমুক্ত করণের পর শেড/ঘর ন্যূনতম ১৪ দিন খালি রাখতে হবে এবং অসময়ের মধ্যে অধিকাংশ জীবাণু মারা যাবে৷

যন্ত্রপাতি তৈরী ও ব্যবহারে সতর্কতাঃ ব্যাটারী ব্রুডার, বিয়ারিং কেইজ, লেয়িং কেইজ ও খামারের অন্যান্য সরঞ্জাম তৈরী ও ব্যবহারের সময় নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে৷ যথা-

ক. তালজালি, জি.আই.তার ও জি.আই. পাতের কাঁটা বা চোখা অংশগুলো মসূণ করে ফেলতে হবে৷

খ. খাঁচাগুলো এমনভাবে তৈরী করতে হবে যেন তাতে ইঁদুর বা অন্যান্য ইঁদুর জাতীয় প্রাণী প্রবেশ করতে না পারে৷

গ. খাদ্য ও পানির পাত্রগুলো সম্পূর্ণভাবে ছিদ্রমুক্ত (Leak proof) হতে হবে৷

ঘ. বিভিন্ন জায়গার ঝালাইগুলো সঠিকভাবে করতে হবে৷

ঙ. মরিচা রোধকল্পে খাঁচা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো উত্কৃষ্টমানের এনামেল পেইন্ট দিয়ে রং করতে হবে৷

চ. প্রয়োজনবোধে, কেইজগুলো সহজে স্থানান্তরের জন্য পায়ার সঙ্গে চাকা লাগানো যেতে পারে৷

ছ. প্রতিটি যন্ত্রপাতির সঠিক ব্যবহার জেনে নিতে হবে, অন্যথায় খামারের মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে৷

জ. যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি কেনার পূর্বে নামকরা ও প্রতিষ্ঠিত কোম্পানীর ওয়ার্যান্টিযুক্ত (Warranty) টেকশই জিনিস কিনতে হবে৷ না হলে আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনা থাকবে৷

কোয়েলের রোগব্যাধি ও প্রতিকারঃ

কোয়েল পালনের প্রধান সুবিধা হচ্ছে এরা মুরগি বা পোল্ট্রির তুলনায় তুলনামুলকভাবে রোগব্যাধিতে কম আক্রান্ত হয়ে থাকে। তাই বলে যে রোগ একেবারে হবে না তা কিন্তু নয়। কোয়েলের রোগব্যাধি কম বলে এদেরকে টিকা দিতে হয় না এবং কৃমির ঔষধও খাওয়ানোর প্রয়োজন পড়ে না। মুরগির প্রায় সবগুলো সাধারণ রোগই কোয়েলকে আক্রান্ত করতে পারে। কোয়েল ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, মাইকোপ্লাজমা, পরজীবী, অপুষ্টি, ব্যবস্থাপনা ত্রুটি ও প্রজনন সংক্রান্ত ত্রুটির কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতে পারে৷ এখানে কোয়েলের কিছু গুরুত্বপূর্ণ রোগ, কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

 সাধারণ রোগ সমূহঃ

  • ক্ষত সৃষ্টিকারী অস্ত্রপ্রদাহ
  • ক্লোমনালী প্রদাহ
  • *অ্যাসপারজিলোসিস বা ব্রুডার নিউমোনিয়া
  • কলিসেপ্টিসেমিয়া
  • রক্ত আমাশয়
  • স্পর্শজনিত চর্মপ্রদাহ
  • মারেক্স রোগ
  • লিম্ফয়েড লিউকোসিস
  • কৃমির আক্রমণ
  • কার্ল টো প্যারালাইসিস
  • ঠোকরা-ঠুকরি বা ক্যানিবালিজম
  • ডিম আটকে যাওয়া

১. ক্ষত সৃষ্টিকারী অস্ত্রপ্রদাহ (Ulcerative enteritis)

ক্ষতসৃষ্টিকারী অস্ত্রপ্রদাহ রোগটি ”কোয়েল” (Quail disease) নামেও পরিচিত৷ কোয়েলের রোগব্যাধির মধ্যে এটিই সবচেয়ে মারাত্মক৷ আক্রান্ত কোয়েলের ১০০%-ও মারা যেতে পারে৷ সাধারণত লিটারে পালিত কোয়েলে এ রোগ বেশি দেখা যায়৷

কারণঃ এটি ব্যাকটেরিয়াজনিত অস্ত্রের রোগ৷ রোগের বিস্তারঃ সাধারণত দূষিত খাদ্যদ্রব্য খাওয়ার মাধ্যমে বাচ্চা কোয়েল এ রোগে আক্রান্ত হয়৷ আক্রান্ত ঝাঁক থেকে সুস্থ ঝাঁকে কীটপতঙ্গের মাধ্যমে এ রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম৷

লক্ষণঃ

  • তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী দু’ধরণের রোগই হতে পারে৷
  • মারাত্মকভাবে আক্রান্ত কোয়েল অনেক সময় কোন লক্ষণ প্রকাশের পূর্বেই মারা যেতে পারে৷
  • মৃদুভাবে আক্রান্ত কোয়েলে অবসাদ দেখা যায়৷
  • চোখ আংশিকভাবে বন্ধ করে রাখে এবং পাখা ঝুলে পড়ে৷
  • রক্তসহ পাতলা পায়খানা হয় এবং পাখির মৃত্যু ঘটে৷
  • দীর্ঘস্থায়ী রোগের ক্ষেত্রে পাখি মাস খানেক রোগে ভুগে দুর্বল হয়ে মারা যায়৷
  • ময়লা তদন্তে (Post Morlem) অস্ত্র ও সিকান্ত্রে (Caeca) বোতাম আকৃতির মারাত্মক ক্ষত বা আলসার দেখা যায়৷

চিকিৎসাঃ চিকিৎসার জন্য ভেটেরিগরি সার্জনের পরামর্শ অনুযায়ী নির্দেশিত মাত্রায় ব্যাসিট্র্যাসিন (Bacitracin) স্ট্রেপটোমাইসিন (Streptomycin), ক্লোরোমাইসেটিন (Chloromycetin) বা এগুলোর পরিবর্তে টেট্রাসাইক্লিন (Tetracycline) অথবা ফুরাজোলিডন (furazolidone) সফলভাবে ব্যবহার করা যায়৷

প্রতিরোধঃ গবেষণায় দেখা গেছে, ৪.৫ লিটার খাবার পানিতে ২ গ্রাম মাত্রায় স্ট্রেপটোমাইসিন মিশিয়ে একাধারে২৫ দিন অথবা স্ট্রেপটোমাইসিন সালফেট মিশিয়ে একাধারে ১০ দিন পান করালে ও রোগ পুরোপুরি প্রতিরোধ করা যায়৷

২. ক্লোমনালী প্রদাহ (Bronchitis) 

কোয়েলের ক্লোমনালী প্রদাহ একটি তীব্র প্রকৃতির প্রদাহজনিত রোগ৷ রোগটি তিন সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে৷ সব বয়সের কোয়েল এতে আক্রান্ত হলেও বাচ্চা কোয়েলের ক্ষেত্রে ৮০% পর্যন্ত মৃত্যু ঘটতে পারে৷

কারণঃ এক ধরণের ভাইরাসের আক্রমণে কোয়েল এ রোগে আক্রান্ত হয়৷

লক্ষণঃ

  • আক্রান্ত কোয়েলে হাঁচি, কাশি ও অস্বাভাবিক শ্বাসের শব্দ লক্ষ্য করা যায়৷
  • কোন কোন সময় চোখ দিয়ে পানি পড়া এবং কনজাংটিভাইটিসও (Conjunctivitis) দেখা যায়৷
  • স্নায়বিক উপসর্গ দেখা যেতে পারে৷

চিকিৎসাঃ ভাইরাসঘটিত রোগ বিধায় এর কোন চিকিৎসা নেই৷ তবে আক্রান্ত কোয়েল চিহ্নিত করে সঙ্গে সঙ্গে বাকিগুলোর কাছ থেকে পৃথক করে সরিয়ে ফেলতে হবে৷ ব্যাকটেরিয়াজনিত মাধ্যমিক সংক্রমণ (Secondary infection) থেকে এদের রক্ষার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক (যেমন- টেট্রাসোইক্লিন) ব্যবহার করা যেতে পারে৷

প্রতিরোধঃ পাখির ঝাঁকে (Flock) গাদাগাদি অবস্থা পরিহার করে সেখানে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল এবং খাদ্য ও পানির ব্যবস্থা করতে হবে৷

 ৩. অ্যামপারজিলোসিস বা ব্রুডার নিউমোনিয়া (Brooder pneumonia) 

এতে প্রধাণত ব্রুডিং পর্বের বাচ্চা কোয়েল আক্রান্ত হয়৷ তাই এই রোগকে ব্রুডার নিউমোনিয়া বলা হয়৷

কারণঃ বাচ্চা মুরগিতে ব্রুডার নিউমোনিয়া সৃষ্টিকারী ”অ্যাসপারজিলাস ফিউমিগেটাস (Aspergillus fumigtus) নামক ছত্রাকের স্পোর  দ্বারা এই রোগ হয়ে থাকে।

রোগের বিস্তারঃ স্পোর দিয়ে দূষিত খাদ্য বা লিটার সামগ্রীর সংস্পর্শে অথবা নিঃশ্বাসের মাধ্যমে স্পোর গ্রহণে বাচ্চা কোয়েল এই রোগে আক্রান্ত হয়৷

লক্ষণঃ

  • রোগ তীব্র আকার ধারণ করলে ক্ষুধামন্দা, পিপাসা বৃদ্ধি, জ্বর ও শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়।
  • পরবর্তীতে বাচ্চা শুকিয়ে যায় ও দুর্বল হয়ে পড়ে।
  • মুরগির বাচ্চার শ্বাসকষ্টের কারণে মুখ হা করে ঘাড় ও মাথা উপরের দিকে টান করে বাচ্চা শ্বাস গ্রহণ করে।
  • শ্বাস প্রশ্বাসের সময় ঘড়ঘড় শব্দ হয়ে থাকে।
  • আক্রান্ত বাচ্চার চোখের পাতা ফুলে যায়। ফলে বয়স্ক বাচ্চার কর্ণিয়া (Cornea) তে ধা বা আলসার দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
  • তীব্র প্রকৃতির রোগের বেলায় মাঝে মাঝে কোনো বৈশিষ্টপূর্ণ উপসর্গ ছাড়াই বাচ্চা মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

চিকিৎসাঃ রোগাক্রান্ত পাখিকে ভেটরিনারি সার্জনের পরামর্শ অনুযায়ী খাদ্য বা পানির সাথে ছত্রাকনাশক ঔষধ মিশিয়ে খাওয়ানোর যায়, কপার সালফেট ১ঃ২০০০ মাত্রায় খাবার পানিতে মিশিয়ে পান করালে বাচ্চা তাড়াতাড়ি সেরে উঠে৷

প্রতিরোধঃ  ঘরের আর্দ্রতা কমিয়ে ও প্রতি কেজি খাদ্যে দুই গ্রাম মাত্রায় ক্যালসিয়াম প্রোপিওনেট (Calcium Propionate) মিশিয়ে খেতে দেয়া যেতে পারে৷ তাছাড়া ঘরের লিটার সবসময় শুকনো রাখতে হবে এবং ব্রুডার এলাকার লিটার নির্দিষ্ট সময় পরপর উল্টেপাল্টে দিতে হবে৷ জমাট বাঁধা, ভিজা ও ছত্রাকযুক্ত লিটার ফেলে দিতে হবে৷

 ৪.কলিসেপ্টিসেমিয়া (Colisepticemia)

কোয়েলের এই মারাত্মক রোগে সব বয়সের পাখিই আক্রান্ত হতে পারে৷ এতে প্রধানত শ্বাসতন্ত্র আক্রান্ত হয়৷ তবে অন্যান্য তন্ত্রও আত্রান্ত হতে পারে৷

কারণঃ ”ইসকোরিশিয়া কলাই” (Escherichia coli) নামক এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার আক্রমনে কোয়েল এই রোগে আক্রান্ত হয়৷

লক্ষণঃ

  • সাধারণত রোগের লক্ষণ প্রকাশের পূর্বেই পাখির মৃত্যু ঘটে৷
  • হঠাত্ পাখির মৃত্যুহার বেড়ে যায়৷
  • শ্বাসতন্ত্রের উপসর্গ, যেমন-মুখ হা করে থাকে, নাকে-মুখে ফেনা ওঠে৷
  • চোখ দিয়ে পানি পড়ে৷

চিকিৎসাঃ প্রতি ৫-১০ কেজি খাদ্যে ৫০০ মি.গ্রা. মাত্রার একটি টেট্রাসাইক্লিন (যেমন বেনামাইসিন) ট্যাবলেট মিশিয়ে আক্রান্ত পাখিবে ৩-৫ দিন খাওয়াতে হবে৷ এছাড়া পানির মাধ্যমেও উক্ত ঔষধ পান করানো যায়৷

 ৫. রক্ত আমাশয় (Coccidiosis)

রক্ত আমাশয় বা ককসিভিওসিস রোগ মুরগিতে যতটা মারাত্মক আকারে দেখা দেয় কোয়েলের ক্ষেত্রে ততটা নয়৷ সাধারণত বাচ্চা কোয়েল এই রোগো আক্রান্ত হয়ে থাকে৷

কারণঃ ”আইমেরিয়া বটেরি” (Eimeria bateri), ”আইমেরিয়া উজুরা” (Eimeria Uzura) ও ”আইমেরিয়া সুনোডাই (Eimeria tsunodai) নামক ককসিডিয়া দ্বারা বাচ্চা কোয়েল আক্রান্ত হতে পারে৷

লক্ষণঃ আক্রান্ত বাচ্চা ঝিমাতে থাকে, রক্ত পায়খানা করে ও দূর্বল হয়ে পড়ে৷ অবশেষে রক্তশূন্যতার কারণে মারা যায়৷

চিকিৎসাঃ প্রতি কুইন্টাল খাদ্যে ১২৫ গ্রাম মাত্রায় অ্যাম্প্রোলিয়াম (Amproluum) মিশিয়ে পরপর তিন দিন আক্রান্ত বাচ্চাকে খাওয়াতে হবে৷

প্রতিরোধঃ ককসিডিওসিস রোগ প্রতিরোধ করতে হলে-

(ক) খামারে স্বাস্থ্যসম্মত ও জীবাণুমুক্ত পরিবেশ বজায় রাখতে হবে৷

(খ) জন্মের দিন থেকে দু’সপ্তাহ পর্যন্ত প্রতি কুইন্টাল খাদ্যে ৬২.৫ গ্রাম মাত্রায় অ্যাম্প্রোলিয়াম খাওয়াতে হবে৷

 ৬. মারেক্স রোগ (Marek’s disease)

মারেক্স রোগ স্নায়ুতন্ত্রের টিউমার সৃষ্টিকারী মারাত্মক ধরণের সংক্রামক রোগ৷ এতে প্রধানত প্রান্তীয় স্নায়ু (যেমন- সায়াটিক ও ব্রাকিয়াল স্নায়ু) আক্রান্ত হয়৷ এমনকি একদিন বয়সের বাচ্চাও আক্রান্ত হতে পারে৷

কারণঃ এক ধরণের হায়পেস ভাইরাস কোয়েলে এই রোগ সৃষ্টি করে৷

রোগের বিস্তারঃ আক্রান্ত পাখির লালা নাকের শ্লেন্মা, মল ও পাখার ফলিকলের (Follicle) মাধ্যমে এই রোগ সুস্থ পাখিকে ছড়ায়৷

লক্ষণঃ

  • সায়াটিক ও ব্রাকিয়াল স্নায়ু মারাত্মক ভাবে ফুলে ওঠে এবং পক্ষাঘাতের সৃষ্টি করে৷
  • দীর্ঘস্থায়ী রোগের ক্ষেত্রে পাখির ওজন হ্রাস পায় এবং ফ্যাকাসে হয়ে যায়৷
  • আক্রান্ত চোখ সাদা হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে একটি বা উভয় চোখই নষ্ট হয়ে যেতে পারে৷
  • ক্ষুধামান্দ্য ও ডায়রিয়া দেখা দেয়৷ ফলে অনাহার ও পানিশূন্যতায় ভুগে পাখি মারা যায়৷

চিকিৎসা ও প্রতিরোধঃ এই রোগের কোন চিকিৎসা নেই৷ প্রতিরোধের জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ও পাখিকে টিকা প্রদান করা উচিত৷ তবে কয়েল যেহেতু কদাচিত্ এই রোগে আক্রান্ত হয় তাই টিকার ব্যবহার প্রচলিত নয়৷

৭. লিম্ফয়েড লিউকোসিস (Lymphoid Leucosis)

লিম্ফয়েড লিউকোসিস এক ধরনের ক্যানসার৷ এটি সাধারণত বয়স্ক কোয়েলকে আক্রান্ত করে৷ আক্রান্ত কোয়েলের ডিম থেকে ফোটানো বাচ্চা এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে৷

কারণঃ এটি অ্যাভিয়ান লিউকোসিস নামক ভাইরাসের কারণে হয়৷

লক্ষণঃ

  • আক্রান্ত পাখি দুর্বল ও কৃশ হয়ে পড়ে৷
  • টিউমার হওয়ার কারণে উদরস্ফীত হয়৷
  • রক্তশূন্যতা দেখা দেয় ও পাখি মারা যায়৷

চিকিৎসা ও প্রতিরোধঃ এই রোগের কোন ফলপ্রসূ চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই৷ কার্যকরী টিকা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি৷ এটি দূর করার জন্য আক্রান্ত পুরো ঝাঁককে মেরে ফেলা উচিত৷

 ৮. কৃমির আক্রমণঃ খাঁচায় পালিত কোয়েলে কৃমির আক্রমণ ঘটে না৷ তবে, লিটারে পালিত কোয়েল কখনো কখনো গোল কৃমি ও ফিতা কৃমি দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে৷ কোয়েল সাধারণত শীতকালেই বেশি আক্রান্ত হয়৷ তবে, কৃমি কোয়েলের তেমন কোন ক্ষতি করতে পারে না৷

কারণঃ পাঁচ প্রজাতির গোল কৃমি বাচ্চা কোয়েল এবং এক প্রজাতির ফিতাকৃমি বয়ষ্ক কোয়েলকে আক্রমণ করতে পারে৷

লক্ষণঃ

  • আক্রান্ত পাখি পাতলা পায়খানা করে৷
  • পালক উস্কো খুস্কো হয়ে যায়৷
  • ধীরে ধীরে শরীর শুকিয়ে যায়৷
  • উৎপাদন হ্রাস পায়৷

চিকিৎসা ও প্রতিরোধঃ আক্রান্ত পাখিকে কৃমিনাশক ঔষধ, যেমন -থায়াবেনডাজল খাওয়ানো যেতে পারে৷ প্রতিরোধের জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে৷ তাছাড়া লিটারে পালিত ব্রিডিং ফ্লককে প্রতিরোধক মাত্রায় কৃমিনাশক ঔষধ খাওয়ানো উচিত৷

 ৯. কার্লড টো প্যারালাইসিস (Curled toe paralysis)

সাধারণত ভিটামিনের অভাবজনিত কারণে কখনো কখনো বাচ্চা কোয়েলে কার্লড টো প্যারালাইসিস রোগ হতে দেখা যায়৷ এতে বাচ্চার পায়ের নখ বা আঙুল অবশঙ্গতার জন্য বাঁকা হয়ে যায়৷

কারণঃ ভিটামিন বি২ বা রাইবোফ্লাভিনের অভাবে এ রোগ হয়৷

লক্ষণঃ

  • পাখি প্রথম দিকে খুঁড়িয়ে হাঁটে এবং এ সময় এর নখ বাঁকা দেখা যায়৷
  • গিরার উপর ভর দিয়ে হাঁটে এবং দাঁড়িয়ে থাকে৷
  • ৮ – ১০ দিনের মধ্যেই ক্ষুধামান্দ্য, ডায়রিয়া, দুর্বলতা, ওজন হ্রাস ইত্যাদি দেখা যায়৷

চিকিৎসা ও প্রতিরোধঃ ভিটামিন বি২-যুক্ত প্রাকৃতিক খাদ্য, যেমন প্রাণীর যকৃত্, সবুজ কচি ঘাস, প্রাণীর কিডনি বা মাছের গুঁড়া ইত্যাদি অথবা ভিটামিন -মিনায়েল প্রিমিক্স নির্ধারিত পরিমাণে সরবরাহ করতে হবে৷

 ১০. ঠোকরা-ঠুকরি বা ক্যানিবালিজম (Cannibalism)ঃ

ক্যানিবালিজম আসলে কোন রোগ নয় বরং এক ধরনের বদভ্যাস৷ এটি এমনই এক ধরনের বদভ্যাস যাতে একটি কোয়েল অন্য একটি কোয়েলের পালকবিহীন বা কম পালকযুক্ত অংশে ঠোকরাতে থাকে এবং রক্ত বের করে ফেলে৷ সাধারণত ব্যাটারি বা খাঁচা পদ্ধতিতেই ঠোকরা-ঠুকরি বেশি দেখা যায়৷

কারণঃ ক্যানিবালিজমের বহু কারণ রয়েছে৷ যেমন-

১. ধারালো ও চোখা ঠোঁট।

২. খামারে গাদাগাদি অবস্থা।

৩.আরজিনিন নামক অ্যামাইনো এসিডের অভাব।

৪. অত্যাধিক আলো।

৫. অত্যাধিক তাপ৷

৬. স্ট্রেস বা পীড়ন৷

৭. আহত পাখিকে সুস্থ পাখি থেকে পৃথক না করা৷

৮. বিভিন্ন বয়সের কোয়েল একই খাঁচায় বা ঘরে রাখা৷

৯. খাদ্যে আমিষ ও লবণের অভাব৷

১০. অপর্যাপ্ত খাদ্য ও পানি সরবরাহ করা৷

১১. অলসতা ইত্যাদি।

চিকিৎসা ও প্রতিরোধঃ যেসব কারণে ঠোকরা-ঠুকরি দেখা দেয় তা দূর করতে হবে৷ তবে আগে থেকেই এদিকটায় নজর দিলে ঠোকরা-ঠুকরি দেখা দেবে না৷ তাছাড়া এটি প্রতিরোধের জন্য সঠিকভাবে ঠোঁট ফাটা বা ডিবিকিং করা একটি উত্তম ব্যবস্থা৷

১১. ডিম আটকে যাওয়াঃ

ডিম পাড়ার সময় অনেক কোয়েলের ডিম ডিম্বনালীতে আটকে যায়, বাইরে বের হতে পারে না। যেহেতু কোয়েল প্রায় প্রতিদিনই ডিম পাড়ে তাই অধিক উৎপাদনশীল কোয়েলে কখনো কখনো এমনটি ঘটতে দেখা যায়।

কারণঃ নিম্নলিখিত কারণে ডিম আটকে যেতে পারে। যেমন-

ক. ডিমের আকার অনেক বড় হলে৷

খ. ডিমের খোসা খসখসে হলে৷

গ. ডিম পাড়ার সময় এক ধরনের পিচ্ছিল পদার্থের নিঃসরণ কম হলে বা না হলে৷

ঘ. ডিম্বাশয়ে প্রদাহ বা অন্য কোন রোগ হলে৷

ঙ. ডিমপাড়া কোয়েলের অত্যাধিক চর্বি হলে৷

চ.ডিম পাড়ার সময় কোয়েলকে বিরক্ত করলে৷

লক্ষণঃ এতে নিম্নলিখিত লক্ষণ দেখা দিতে পারে৷ যেমন-

ক. কোয়েল সবসময় ছটফট করে৷

খ. ডিম পাড়ার জন্য বারবার যায় কিন্তু ডিম না পেড়ে চলে আসে৷

গ. ঘনঘন কোঁথ দেয়৷

ঘ. পায়ুপথ দিয়ে রক্ত বের হতে পারে৷

ঙ. পেটে ডিম ভেঙ্গে গেলে কোয়েল মারা যায়৷

চিকিৎসাঃ গরম পানিতে এক টুকরা কাপড় ভিজিয়ে নিয়ে কোয়েলের পায়ুপথের চারদিকটায় হালকাভাবে বুলিয়ে দিতে হবে। এরপর আঙুলের সাহায্যে ভেসিলিন জাতীয় পিচ্ছিল পদার্থ পায়ুপথের ভিতর দিয়ে ডিম্বনালীর চারপাশে লাগালে তা পিচ্ছিল হয়। ফলে ডিম বের হয়ে আসে। বিশেষ পরামর্শঃ জন্মের প্রথম সপ্তাহে প্রতি লিটার খাবার পানিতে এক গ্রাম মাত্রায় টেট্রাসাইক্লিন মিশিয়ে পান করালে ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকজনিত রোগের কবল থেকে বাচ্চা কোয়েলকে রক্ষা করা সম্ভব হয়।

কোয়েল খামার পরিকল্পনাঃ

যে-কোন খামার থেকে (যেমন- লেয়ার, ব্রয়লার বা ব্রিডার) বাণিজ্যিক সাফল্য পেতে হলে চাই সুষ্ঠু পরিকল্পনা৷ এছাড়াও প্রয়োজন কারিগরি জ্ঞান ও দক্ষতা৷ কোয়েল আকারে ছোট ও ওজনে কম হওয়ায় কম খায় এবং অল্প জায়গায় অধিক পালন করা যায়৷ তাছাড়া প্রারম্ভিক খরচ অত্যন্ত কম বিধায় যে-কেউ অল্প পুঁজিতে ছোট আকারের কোয়েল খামার দিয়ে ব্যবসা শুরু করতে পারেন৷ ব্রয়লার বা লেয়ার যে ধরনের খামারই গড়া হোক না কেন তার জন্য অবশ্যই একটি সুন্দর ও সঠিক পরিকল্পনা থাকতে হবে৷ খামার প্রতিষ্ঠার সময় নিম্নলিখিত বিষয়গুলি বিবেচনায় রাখতে হবে৷ যথা-

১. মূলধন,

২. জমি,

৩.উত্পাদিত দ্রব্যের চাহিদা বা বাজার,

৪. উন্নত গুণসম্পন্ন হ্যাচিং ডিম ও একদিন বয়সের বাচ্চা পাওয়ার সুবিধা,

৫.খাদ্যের সহলভ্যতা ও সংগ্রহ করার সুবিধা,

৬. পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা,

৭. বিদ্যুৎ  ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা।

খামার স্থাপন ও পরিচালন খরচঃ

খামার স্থাপন ও পরিচালনার খরচ মূলত তিন প্রকার, যথা-

১. স্থায়ী খরচ

২. অস্থায়ী খরচ, এবং

৩.আবর্তন বা চলমান খরচ

খামারের আয়ঃ

ব্রয়লার বা লেয়ার কোয়েলারীর আয়ের মধ্যে রয়েছে-

১.জীবিত ব্রয়লার বা মাংস/ডিম বিক্রিবাবদ আয়,

২. লেয়ারের ক্ষেত্রে উৎপাদন  শেষে জীবিত কোয়েলী বিক্রিবাবদ আয়৷

৩. বিষ্ঠা বা ব্যবহৃত লিটার বিক্রিবাদ আয়,

৪. পুরনো বা অকেজো জিনিসপত্র বিক্রিবাবদ আয় ইত্যাদি৷

কোয়েল খামার নির্মাণ খরচ এলাকার জমি ও নির্মাণ সামগ্রীর স্থানীয় মূল্য, খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর মূল্য, পানি ও বিদ্যুত্ ব্যবস্থাপনা, বিপণন প্রভৃতির উপর অনেকখানি নির্ভর করে৷ এখানে পারিবারিকভাবে পালনের জন্য ৫০০ লেয়ার কোয়েলের একটি প্রকল্পের মডেল দেখানো হয়েছে৷ এখানে জমির মূল্য ধরা হয়নি৷ এখানে দেখানো হিসাবের সঙ্গে প্রকৃত হিসাবের কিছুটা হের-ফের হতে পারে৷

প্রকল্পঃ

১. স্থায়ী খরচঃ স্থায়ী খরচের মধ্যে মূলত ঘর তৈরি বাবদ খরচই ধরা হয়েছে৷ এক বর্গফুট (৯০০ বর্গ সে.মি.) জায়গায় ৬-৮টি (গড়ে ৭টি) বড় কোয়েল পালন করা যায়৷ তাই ৫০০টি লেয়ার কোয়েলের জন্য মোট জায়গায় প্রয়োজন হবে প্রায় (৫০০÷৭) = ৭১.৪ বর্গফুট৷ লেয়ার যেহেতু প্রায় ৬০ সপ্তাহ পালন করা হয় তাই কিছু জায়গা বাড়িয়ে ৭৫ বর্গফুট করলে ভালো হয়৷ বাঁশ, কাঠ, টিন প্রভৃতি ব্যবহার করে প্রতি বর্গফুট ঘরের নির্মাণ খরচ ৫০ টাকা হিসাবে ধরা হলো৷ এতে ঘর তৈরি বাবদ খরচ হবে ৭৫´৫০ = ৩৭৫০ টাকা৷ [দ্রষ্টব্যঃ এখানে ডিপ লিটারে পালনের হিসাব ধরা হয়েছে৷ তবে ব্যাটারী বা সমল্বিত পদ্ধতিতে পালন করলে ঘর ছাড়াও প্রয়োজনীয় খাঁচার ব্যবস্থা করতে হবে৷ তাই, কাঁচামালের দামের উপর নির্ভর করে খাঁচা তৈরির জন্য বাড়তি খরচ যুক্ত হবে৷]

২.অস্থায়ী খরচঃ অস্থায়ী খরচের মধ্যে রয়েছে-

যন্ত্রপাতির নাম পরিমণা দর টাকা
ক. ব্রুডার  ৩০০ ৬০০/=
খ. হিটার/স্টোভ ২৫০ ৫০০/=
গ. প্লাস্টিকের চিক ফিড ট্রে ২৫ ১৫০/=
ঘ.  ছোট লম্বা খাবারপাত্র ৪০ ২৪০/=
ঙ. প্লাস্টিকের তৈরি হ্যাচিং ফিডার ১৫ ৩০ ৪৫০/=
চ. ছোট পানির পাত্র ২৫ ১৫০/=
ছ. বড় পানির পাত্র ১৫ ৩৫ ৫২৫/=
জ. ডিম পাড়ার বাক্স ৫০ ২০ ১০০০/=
ঝ. বাল্ব ২০ ১২০/=
ঞ. নিক্তি বা ব্যালান্স (বড়)

নিক্তি বা ব্যালান্স (ছোট)

৭০০

৩০০

৭০০/=

৩০০/=

ট. বালতি, বেলচা, কোদাল, চাকু ইত্যাদি বাবদ খরচ ৫০০/=
ঠ. অন্যান্য ৫০০/=
মোট ৫,৭৩৫/=

 

৩. চলমান খরচঃ চলমান খরচের মধ্যে রয়েছে-

ক.  একদিন বয়সের কোয়েলের বাচ্চা (৫% অতিরিক্ত ধরতে হবে) (৫২৫´১০) = ৫,২৫০/=
খ. খাদ্য খরচ (প্রতিটি কোয়েল ৬০ সপ্তাহে ৮.৫ কেজি করে খাদ্য খাবে প্রতি কেজি খাদ্যের মূল্য ১৭ টাকা ধরে) (৫২৫´৮.৫´১৭) = ৭৫,৮৬২/=
গ. ঔষধ+ভিটামিন+অন্যান্য = ১,৫০০/=
ঘ. লিটার সামগ্রী (২০ বস্তা) (২০ ´৫০) = ১,০০০/=
ঙ. বিদ্যুত্ বিল (৬০ সপ্তাহ) = ১,২০০/=
চ. পানির বিল (৬০ সপ্তাহ) (নিজস্ব পানির ব্যবস্থা থাকলে প্রয়োজন নেই) = ১.২০০/=
ছ. স্থায়ী খরচের ৫% এর ১.১ (৬০সপ্তাহ) (৩৭৫০´ ৫% ´ ১.১) = ২০৬/=
জ. অস্থায়ী খরচের ২০% এর ১.১ (৫৭৩৫ ´ ২০% ´১.১) = ১,২৬২/=
মোট = ৮৭,৪৮০/=

 

আয়:

ক. ডিম বিক্রি বাবদ- ৬ সপ্তাহ থেকে ৬০ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত মোট ৫৪ সপ্তাহে গড়ে ৭৫% হিসাবে মোট ডিম উত্পাদন  (৫৪ ´৭ ´৫০০ ´৭৫÷ ১০০) = ১৪১৭৫০টি

প্রতিটি ডিম ১.১০ (পাইকারী) হিসাবে বিক্রিবাবদ আয়

১,৫৫,৯২৫/=
খ. বাতিল লেয়ার কোয়েল বিক্রিবাবদ আয় (৫% মৃত্যু ধরে) (৫০০´ ২৫) ১২,৫০০/=
গ. লিটার সার বিক্রি (৬০ বস্তা)  (৬০´২০) ১,২০০/=
মোট= ১,৬৯,৬২৫/=

লাভ: প্রতি ব্যাচ তথা ৫৪ সপ্তাহে লাভ = আয় – চলমান খরচ (১,৬৯,৬২৫ – ৮৭,৪৮০) = ৮২,১৪৫//

অতএব, মাসিক লাভ = (৮২১৪৫÷ ১৫.৫ বা ৬০ সপ্তাহ) =৬,০৮৪/- (২০০৪ সালের দর অনুযায়ী)

উল্লেখ্য, কোয়েল খামার তৈরিতে স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত নির্মাণ সামগ্রী, যেমন- বাঁশ, কাঠ, টিন ইত্যাদি ব্যবহার করলে খরচ অনেক কম পড়বে৷ তাছাড়া খামারের অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও উপকরণ, যেমন- খাবারপাত্র, পানিরপাত্র, ব্রুডার, হিটার ইত্যাদি যত কম দামে কেনা যায় খামারের জন্য ততই ভালো।

তথ্যসূত্রঃ ”কোয়েল পালন”, ডাঃ আ ন ম আমিনুর রহমান, প্রকাশকঃ পড়ুয়া, ঢাকা, ২০০৪ (দ্বিতীয় সংষ্করণ)

 

 

2394 total views, 1 view today

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

As you found this post useful...

Follow us on social media!

We are sorry that this post was not useful for you!

Let us improve this post!

Please don't forget to share this article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি। সকল স্বত্ব www.agriculturelearning.com কর্তৃক সংরক্ষিত

preload imagepreload image