কালিজিরার পরিচিতি, ঔষধি গুনাগুণ এবং এর উৎপাদন কৌশল
কালিজিরার ইংরেজি নাম Fennel flower, Nutmeg flower, Roman Coriander, Blackseed or Black caraway, Black Cumin । বৈজ্ঞানিক নামঃ Nigella sativa L. এবং পরিবারঃ Ranunculaceae। অন্যান্য বাংলা নাম কালিজিরা, কালোজিরা, কালো কেওড়া, রোমান ধনে, নিজেলা, কালঞ্জি এসব। যে নামেই ডাকা হোক না কেন এ কালো বীজের গুণাগুণ স্বাস্থ্য উপকারিতা অপরিসীম অসাধারণ কালজয়ী।
কালিজিরার আদি নিবাস দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়া। কেউ কেউ বলেন ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে এর উৎপত্তি স্থান। ওষুধ শিল্প, কনফেকশনারি শিল্প ও রন্ধনশালায় নিত্যদিনের ব্যঞ্জরিত খাবার তৈরিতে কালিজিরার জুড়ি নেই। বিভিন্ন খাবারের পাশাপাশি পানীয় দ্রব্যকে রুচিকর ও সুগন্ধি করার জন্য এটি ব্যবহার করা হয়।
আমাদের দেশে মসলা ফসলের মধ্যে কালিজিরার ব্যবহার তুলনামূলকভাবে কম। মসলা হিসেবে ব্যাপক ব্যবহার আছে বিশ্বব্যাপী। পাঁচ ফোড়নের একটি অন্যতম উপাদান। কালিজিরা আয়ুর্বেদীয়, ইউনানি, কবিরাজি ও লোকজ চিকিৎসায় বহু রকমের ব্যবহার আছে। প্রসাধনীতেও ব্যবহার হয়। কালিজিরার যে অংশটি ব্যবহার করা হয় তাহলো শুকনো বীজ ও বীজ থেকে পাওয়া তেল।
ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা কালিজিরাকে একটি অব্যর্থ রোগ নিরাময়ের উপকরণ হিসেবে বিশ্বাস করে। হাদিসে আছে কালিজিরা মৃত্যু ব্যতীত অন্য সব রোগ নিরাময় করে। এজন্য কালিজিরাকে সব রোগের ওষুধ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। নিয়মিত ও পরিমিত কালিজিরা সেবনে শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে সতেজ করে ও সার্বিকভাবে স্বাস্থ্যের উন্নতি সমৃদ্ধি সাধন করে। আশ্চর্য বীজ কালিজিরার উপকারিতা বহুমুখী।
কালিজিরার ঔষধি গুণঃ কালিজিরা আয়ুর্বেদীয়, ইউনানি, কবিরাজি ও লোকজ চিকিৎসায় বহুবিধ রোগ নিরাময়ের জন্য ব্যবহার হয়। মসলা হিসেবে ব্যাপক ব্যবহার হলেও ইউনানি মতে নারীদের বিভিন্ন রোগে ও সমস্যায় কালিজিরা অব্যর্থ মহৌষধ। এছাড়া প্রসবকালীন ব্যথা কমাতে, প্রসূতির স্তনে দুগ্ধ বৃদ্ধির জন্য প্রসবোত্তর কালিজিরা বাটা ভর্তা খাওয়ার প্রমাণিত উপকারী বিধান আছে। প্রশ্বাব বাড়ানোর জন্য কালিজিরা খাওয়া হয়। জ্বর, সর্দি, কাশি, কফ, অরুচি, উদরাময়, শরীর ব্যথা, গলা ব্যথা ও দাঁতের ব্যথা, বাতের ব্যথা, পেটের বাথা, মাথাব্যথা কমাতে, মাথা ঝিমঝিম করা, মাইগ্রেন নিরাময়ে যথেষ্ট উপকারী বন্ধু হিসেবে কাজ করে। পেটফাঁফা, চামড়ার ফুসকুরি, ব্রঙ্কাইটিস, এলার্জি, একজিমা, এজমা, শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানি রোগ; ডায়রিয়া, আমাশয়, গ্যাসট্রিক আলসার, জন্ডিস, খোসপাঁচড়া, ছুলি বা শ্বেতি, অর্শরোগ, দাদে কালিজিরা অব্যর্থ ওষুধ হিসেবে কাজ করে। স্নায়ুবিক উত্তেজনা; উরুসদ্ধি প্রদাহ; আঁচিল; স্মরণশক্তি বৃদ্ধিতে; শরীরের অতিরিক্ত মেদ কমাতে, স্ট্রোক, স্থূলতা নিরাময়ে দারুণ কাজ করে কালিজিরা। গায়ের ব্যথা দূর করতে কালিজিরা বিশেষভাবে উপকার করে। ক্যান্সার প্রতিরোধক হিসেবে কালিজিরা সহায়ক ভূমিকা পালন করে। কালিজিরা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে, বহুমূত্র রোগীদের রক্তের শর্করার মাত্রা কমিয়ে দেয় ইনসুলিন সমন্বয় করে ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রণ করে। হার্টের বিভিন্ন সমস্যা, হাইপারটেনশন, নিম্ন রক্তচাপকে বাড়ায় আর উচ্চ রক্তচাপকে কমিয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি কমিয়ে রক্তের স্বাভাবিকতা রক্ষা করে। এছাড়া মস্তিষ্কের রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধির মাধ্যমে স্মরণশক্তি বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে।
জাত পরিচিতিঃ
এন.এস-৪৪ এই জাতটি ১৪০-১৫০ দিনে চাষ করে প্রতি হেক্টরে ৪.৫-৬.৫ কুইন্টাল ফলন পাওয়া যায়।
এন.এস-৩২ এই জাতটি ১৪৫-১৫০ দিনে চাষ করে হেক্টর প্রতি ফলন পাওয়া যেতে পারে ৪.৫-৬.৫ কুইন্টাল।
বারি কালিজিরা-১ এর প্রতিটি গাছে ৫-৭ গ্রাম বীজ হয়। প্রতি ১০০ গ্রাম বীজের ওজন ৩.০-৩.২৫ গ্রাম। বীজ পরিপক্ব হতে ১৩০-১৪৫ দিন সময় লাগে। দেশি জাতের কালিজিরা পরিপক্ব হতে আরেকটু কম সময় লাগে। বাংলা কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে এর ফুল ফোটে এবং শীতকালে ফল ধরে, শীতের শেষে ফল পাকে।
কালিজিরার উৎপাদন কৌশলঃ শুকনা ও ঠাণ্ডা আবহাওয়া কালিজিরা আবাদে খুব অনুকূল। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ আবহাওয়া বালাইয়ের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। ফুল ফোটার সময় বৃষ্টি হলে কালিজিরার ফলন কমে যায়। ৩ থেকে ৪টি চাষ ও আড়াআড়ি মই দিয়ে মাটি ঝুরাঝুরা করে আগাছা পরিষ্কার করে জমি সমতল করে বীজ বপন করতে হয়। অল্প পরিমাণ এক বিঘা বা তার কম জমিতে চাষ করলে ৫ সেন্টিমিটার বা ২ ইঞ্চি উঁচু বেড তৈরি করা ভালো।
বীজের হার ও বীজ বপনঃ অক্টোবর-নভেম্বর মাসে বীজ বপন করা যায়। তবে নভেম্বর মাসের প্রথম-দ্বিতীয় সপ্তাহ বীজ বপন করার উত্তম সময়। অগ্রহায়ণের শেষ থেকেই লাগানো যায়। বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকলে পৌষের প্রথমে লাগানো ভালো। সফলভাবে কালিজিরা উৎপাদনের জন্য ১৫x১০ সেন্টিমিটার দূরত্বে লাইনে বীজ বপন করলে ভালো হয়। ১-৪ ইঞ্চি গর্ত করে প্রতি গর্তে ২-৩টি করে বীজ পুঁততে হবে। খেয়াল রাখতে হবে বীজ যেন বেশি গভীরে না যায়। বীজ বপনের আগে আলাদা করে শোধনের দরকার নেই। তবে বোনার আগে ভালো করে ধুয়ে ধুলাবালি ও চিটা বীজ সরিয়ে নেয়া ভালো। ভেজা বীজ বপন করা উচিত না। ১ বিঘা জমিতে ১-১.৫ কেজি বীজ লাগে। হেক্টরপ্রতি ৪-৬ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। তবে লাইনে লাগালে ৩.৫-৪.৫ কেজি বীজই যথেষ্ট।
সার প্রয়োগ : জমি তৈরির সময় ছাড়া পরে আর সার দেয়া তেমন প্রয়োজন নেই। জৈব ও অজৈব সারের সমন্বয়ে হেক্টরপ্রতি সারের পরিমাণ হলো পচা গোবর ৫ থেকে ১০ মেট্রিক টন, ইউরিয়া ১২৫ কেজি, টিএসপি ৯৫ থেকে ১০০ কেজি, এমওপি ৭৫ কেজি। জমি তৈরি ও শেষ চাষের সময় জৈবসার, অর্ধেক ইউরিয়া, পুরো টিএসপি ও এমওপি মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। বীজ বপনের ৪০ দিন পর বাকি ইউরিয়া উপরিপ্রয়োগ হিসেবে জমিতে মিশিয়ে দিতে হবে। কেউ কেউ ভালো ফলনের জন্য খৈল ব্যবহার করেন।
পরিচর্যাঃ বীজ লাগানোর পরই হালকা করে মাটি দিয়ে গর্ত ঢেকে দিতে হবে। পাখিতে বীজ খেতে না পারে, সতর্ক থাকতে হবে। এছাড়া প্রয়োজন হলে আগাছা পরিষ্কার, গাছ পাতলাকরণ কাজগুলো নিয়মিত ও পরিমিতভাবে করতে হবে।
সেচ ও নিকাশ : সাধারণত সেচের প্রয়োজন নেই। তবে নতুন চারা লাগানোর পর রোদ বেশি হলে ছিটিয়ে পানি দেয়া যায়। সন্ধ্যায় পানি ছিটিয়ে দেয়া ভালো। জমিতে রস না থাকলে বীজ বপনের পর হালকা সেচ দিতে হবে। তবে প্লাবন সেচ দিলে বীজ এক জায়গায় জমা হয়ে যেতে পারে। মাটির ধরন আর বৃষ্টির ওপর নির্ভর করে পুরো জীবনকালে ২-৩ বার সেচ দিতে হবে। কোনো কারণে জমিতে পানি জমলে দ্রুত নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।
কালিজিরার পোকামাকড় ও রোগ দমন ব্যবস্থাপনাঃ কালোজিরা প্রধানত শুঁটি ছিদ্রকারী পোকা এবং ধ্বসা, মরচে, সাদা-গুঁড়ো ইত্যাদি রোগের দ্বারা আক্রান্ত হয়।
প্রতিকারঃ ল্যাদা পোকা ধরে কেরোসিন তেলে ডুবিয়ে মারার পাশাপাশি ৪% এন্ডোসালফান ও ম্যালাথিয়ন গুঁড়ো প্রতি হেক্টরে ২৫ কেজি হারে ছড়িয়ে বা ০.০৫% ইমিডাক্লোপ্রিড স্প্রে করে এই পোকা নিয়ন্ত্রন করা যায়।
ধ্বসা রোগঃ Alternaria sp. জাতীয় ছত্রাক দ্বারা আক্রমণে এ রোগ হয়। আক্রান্ত গাছের ডালপালা ঘন বাদামী থেকে কালচে রঙের হয়। পাতা ঝরে পড়ে এবং গাছ শুকিয়ে যায়।
প্রতিকারঃ আক্রান্ত গাছে ম্যানকোজেব জাতীয় ছত্রাকনাশক ( রিডোমিল গোল্ড বা ডাইথেন এম ৪৫ ) প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ২-৩ বার ১০ দিন পরপর ছিটিয়ে দিতে হবে।
মরচে পড়া রোগঃ Puccinia bulcocastani নামক ছত্রাকের আক্রমণে পাতা ও পত্রবৃন্তে ছোট ছোট, হলুদাভ, মরচে ধরা দাগ দেখা যায়। রোগের চুড়ান্ত পর্যায়ে পাতা ও বৃন্ত কুঁকড়ে যায় ও ঝুলে পড়ে।
প্রতিকারঃ রোগের আক্রমণ বেশি হলে দমনের জন্য ম্যানকোজেব বা কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক ২ গ্রাম/লিটার পানিতে ১০-১২ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করা যেতে পারে।
পাউডারি মিলডিউ/সাদাগুঁড়ো রোগঃ Erysiphe Polygoni নামক ছত্রাকের সংক্রমনে এই রোগ হয়। প্রথমে পাতা ও কান্ডে সাদা গুঁড়ো দাগ দেখা যায়, ক্রমে রোগের লক্ষণ ছড়িয়ে পড়ে এবং গাছ সাদা হয়ে যায়। আক্রান্ত ক্ষেতে ফলনের পরিমাণ ও গুনমান কম হয়ে যায়।
প্রতিকারঃ রোগের লক্ষণ দেখা দিলে নিয়ন্ত্রনের জন্য মেনকোজেব + কার্বেন্ডাজিম জাতীয় ছত্রাকনাশক ২ গ্রাম/লিটার হারে ১০-১২ দিন অন্তর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
জীবনকাল : অঙ্কুরোদগম-চারা গজানো- ১২-১৬ দিন; গাছের বৃদ্ধি- ৩০-৪০ দিন; ফুল আসবে ৩৫-৪২ দিন; ফল আসবে ৪২-৫৫ দিন; ফল পাকবে : ৬০ থেকে ৮৫ দিন। বীজ বপনের পর সর্বমোট ১৩৫-১৪৫ দিনে গাছ হলদে বর্ণ ধারণ করে মরে যায়। ১৫-২০ সপ্তাহের মধ্যে ফসল পাকবে ও তোলার সময় হবে অর্থাৎ পৌষের প্রথমে চাষ করলে ফাল্গুন-চৈত্রে ফসল তোলা যাবে।
ফসল সংগ্রহ ও ফলন : ১ বিঘা জমিতে চাষ করলে গড়ে ৯০-১১০ কেজি কালিজিরা পাওয়া যাবে। একরপ্রতি ৩০০ কেজি থেকে ৩৩০-৩৪০ কেজি পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। বারি কালিজিরা-১ সঠিক পরিচর্যায় হেক্টরপ্রতি ১ মেট্রিক টন পর্যন্ত ফলন দেয়।
ফাল্গুন-চৈত্রে গাছ মরে গেলে গাছ থেকে ফল সংগ্রহ করে ২ দিন রোদে শুকিয়ে নিয়ে হাতে সাবধানে আঘাত করে মাড়াই করে বা লাঠি দিয়ে বীজ সংগ্রহ করা যায়। গাছে সামান্য রস থাকতেই ফল সংগ্রহ করা উচিত, তা নাহলে বীজ জমিতে ঝরে পড়তে পারে। বীজ রোদে শুকিয়ে ঠাণ্ডা করে কুলা দিয়ে পরিষ্কার করে চটের বস্তায় বা মাটির পাত্রে বীজ সংরক্ষণ করতে হবে। এভাবে অন্তত এক বছর পর্যন্ত বীজ ভালোভাবে সংরক্ষণ করা যায়। মানসম্মত বীজ সংরক্ষণে পাত্র শুকনো, ঠাণ্ডা, অন্ধকার জায়গায় রাখতে হবে।
631 total views, 1 view today
How useful was this post?
Click on a star to rate it!
We are sorry that this post was not useful for you!
Let us improve this post!
Thanks for your feedback!