জারা লেবুর উৎপাদন কৌশল, বাজারজাতকরণ ও সম্ভাবনা
জারা লেবু অত্যন্ত জনপ্রিয় ও রপ্তানিযোগ্য একটি ফসল। অন্যান্য লেবুর চেয়ে জারা লেবু একটু আলাদা। সাধারণত আমরা লেবুর রস খেয়ে থাকি কিন্তু জারা লেবুর খাওয়া হয়ে থাকে চামড়া। খাবার টেবিলে সালাদ হিসাবে জারা লেবুর বেশ কদর রয়েছে। এ লেবুটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি সাধারণ লেবুর থেকে অনেক বেশি বড়। দেখতে অনেকটা জালি কুমড়ার মতো বড় হয়ে থাকে। লেবুর রস তেমন না থাকলেও তা খেতে খুবই সু-স্বাদু।
এর চামড়ায় একটি বিশেষ ধরণের মিষ্টি গন্ধ রয়েছে। এই মিষ্টি স্বাদটা ভোক্তাদের কাছে খুবই প্রিয়। লেবুটির খোসা দিয়ে আচারও তৈরি করা হয়। একটি লেবুর ওজন দুই থেকে চার কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। বর্তমানে সিলেটসহ বাংলাদেশের সব এলাকায় এ লেবুর চাহিদা বেশ বাড়ছে এবং লেবুটি বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। জারা লেবুর প্রধান ক্রেতা প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
জারা লেবু লেবু দোঁ-আশ ও পানি নিষ্কাশনের ক্ষমতা সম্পন্ন অম্লীয় মাটিতে ভালো জন্মে থাকে।
জাতঃ বারি জারা লেবু -১ নামের উচ্চফলনশীল একটি জাত রয়েছে।
লেবুর বংশবিস্তারঃ জারা লেবু বীজ থেকে এবং কলম করে দুইভাবেই চারা উৎপাদন করা যায়। সাধারণত গুটি কলমের মাধ্যমে বংশবিস্তার করা হয়। অঙ্গজ উপায়ে চারা উৎপাদন করলে গাছের মাতৃ গুনাগুন বজায় থাকে। কলমের চারাতে ১-১.৫ বছরেই ফল ধরে। তাই বীজের চারার চেয়ে কলমের চারাই উত্তম।
জমি তৈরি ও রোপণ পদ্ধতিঃ জমিতে চারা বা কলম রোপণ করার ১৫-২০ দিন আগে ৮ হাত বাই ৮ হাত দুরত্বে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং গভীরতা ৬০ সেন্টিমিটার করে গর্ত তৈরি করতে হবে। গর্তের উপরের মাটির সাথে ২০০ গ্রাম টিএসপি, ২০০ গ্রাম এমওপি সার ও ২০ কেজি গোবর সার বা ৫কেজি কোম্পোষ্ট সার ভালভাবে মিশিয়ে নিয়ে গর্ত ভরাট করে দিতে হবে।
চারা রোপণের সময়ঃ মে থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত চারা লাগানো জন্য উপযুক্ত সময়।
গাছে সার প্রয়োগ পদ্ধতিঃ চারা লাগানের পর ভালো ফলন পেতে হলে নিয়মানুযায়ী সঠিক পরিমাণে সার প্রয়োগ করতে হবে। নিম্নে বয়স অনুসারে গাছপ্রতি সারের পরিমাণ দেওয়া হলো।
গাছের বয়স (বছর) | পচা গোবর (কেজি) | ইউরিয়া (গ্রাম) | টিএসপি (গ্রাম) | এমওপি (গ্রাম) | জিপসাম (গ্রাম) | জিংক (গ্রাম) | বোরণ (গ্রাম) |
১-২ | ২৫ | ২৫০ | ২৫০ | ২৫০ | ১০০ | ২৫ | ৫০ |
৩-৫ | ৩০ | ৫০০ | ৪০০ | ২৫০ | ১৫০ | ৩০ | ৬০ |
৬ বা তর্দুধ | ৪০ | ৫০০ | ৪০০ | ৪০০ | ২০০ | ৪০ | ৭৫ |
উপরের বর্ণিত সার তিনভাগে ভাগ করে তিন কিস্ততে গাছের গোড়া হতে কিছুটা দুরে ছিটিয়ে মাটি আগলা করে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। পাহাড়ের ঢালের গাছের জন্য ডিবলিং পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। প্রথম কিস্তির সার বর্ষার প্রথমে অর্থাৎ বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে এবং দ্বিতীয় কিস্তির সার মধ্য ভাদ্র থেকে কার্তিক ( সেপ্টাম্বর-অক্টবর ) মাসে ও তৃতীয় কিস্তির সার মাঘ-ফাল্গুন ( ফেব্রুয়ারি ) মাসে প্রয়োগ করতে হবে।
অঙ্গ ছাটাইঃ লেবু গাছের শুকনো, মরা, রোগাক্রান্ত, লিকলিকে ও অপ্রয়োজনীয় ডালপালা ছাঁটাই করেতে হবে। গাছের গোড়ার দিকে জল শোধক শাখা এবং ভেতরের দিকে দুর্বল ডালপালা, মধ্য কার্তিক (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) মাসে ছাঁটাই করে দিতে হবে। ডালপালা ছাঁটাই করার পর কর্তিত স্থানে হলুদের গুড়ো লাগিয়ে দিলে ছত্রাকের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
পানি সেচ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থাঃ জারা লেবুর বাগানে খরা মৌসুমে ২-৩ বার সেচ দিতে হবে। এছারা মাটির রস শুকিয়ে গেলে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। লেবু জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না তাই বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাতের সময় পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। গোড়ায় যাতে পানি না জমে সেজন্য নালার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
লিফ মাইনার বা ছোট সুড়ঙ্গকারী পোকাঃ জারা লেবুর পোকামাকড়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেলিফ মাইনার বা সুড়ঙ্গকারী পোকা। যার কীড়াগুলো লেবু গাছের পাতার উপত্বকের ঠিক নিচের সবুজ অংশ খেয়ে থাকে এবং আকা-বাকা সুড়ঙ্গের মতো তৈরি করে। পরবর্তীতে পাতার কিনারার দিকে মুড়ে পুত্তলিতে পরিণত হয়ে যায়। লিফ মাইনারের আক্রমণের মাত্রা তীব্রভাবে দেখাদিলে গাছের পাতা কুঁকড়ে যায় ও বিবর্ণ হয়ে শুকিয়ে পাতা ঝড়ে পড়ে। মুলত আগস্ট ও অক্টোবর মাসে এ পোকা বেশি দেখা যায়।
প্রতিকার :
- ডিম ও কীড়াসহ পাতা সংগ্রহ করে মাটিতে পুতে রাখতে হবে অথবা পুড়িয়ে ফেলতে হবে
- নতুন পাতা গজানের সময় কচি পাতায় স্পর্শ ও পাকস্থলী বিষ (ফেনিট্রোথিয়ন ৫০ ইসি, সাইপারমেথ্রিন ১০ ইসি) অথবা (ডাইমেথয়েট ৪০ ইসি, কার্বোসালফান ২০ ইসি) জাতীয় কীটনাশক ২ মিলি প্রতি লিটার পানি বা ১ গ্রাম প্রতি লিটার পানির সাথে মিশিয়ে ১০-১৫ দিন পরপর ৩ থেকে ৪ বার গাছে ভালো করে স্প্রে করতে হবে।
লাল মাকড়ঃ লাল মাকড় লেবু জাতীয় ফসলের কচিপাতা ও ফলে আক্রমণ করে। এ পোকার আক্রমণে পাতার নিচের দিক বাদামি বর্ণ হয়ে পাতা কুঁকড়ে যায় ও গাছ বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
প্রতিকার:
- আক্রমণের প্রথম দিকেই আক্রান্ত পাতা সংগ্রহ করে মাটির নিচে পুতে অথবা পুড়িয়ে ফেলতে হবে
- এছাড়া মাকড়নাশক যেমন ওমাইট ৫৭ ইসি ১.৫ মিলি বা ভারটিম্যাক প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
লেবুর ক্যাঙ্কাররোগঃ জারা লেবুর রোগের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো ক্যাঙ্কাররোগ যাব্যাকটেরিয়া জনিত রোগ। গাছের কচিপাতায়, বাড়ন্ত কুঁড়িতে, ও ফলে এ রোগের আক্রমন বেশি হয়ে থাকে।
প্রতিকার:
- রোগের প্রাদুর্ভাব প্রকট আকার ধারণ করলে কুপ্রাভিট ৮০ ডব্লিউপি প্রতি লিটার পানিতে ৭ গ্রাম হারে ১০-১৫ দিন স্প্রে করতে হবে
- বোর্দোমিশ্রণ (১০০গ্রাম তুঁতে ও ১০০ গ্রাম চুন লিটার পানিতে মিশিয়ে ) ৭-১০ দিন পরপর স্প্রে করতে হবে।
স্ক্যাবরোগঃ স্ক্যাব রোগের ক্ষেত্রেলেবুর চামড়ার উপর ছোট ছোট বাদামি বা লালচে বাদামি দাগ দেখা যায়। এ দাগগুলো দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে থাকে এবং খসখসে হয়ে যায় যা দেখতে অনেকটা দাদ রোগের মতে মনে হয়ে থাকে। লেবুর গায়ের কিছু কিছু দাগ গভীর হয়ে থাকে আবার কিছু কিছু দাগ বাহিরের দিকে খাড়া হয়ে থাকে।
এ রোগ প্রতিকারের জন্য ম্যানকোজের জাতীয় ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২.০ গ্রাম হারে ১০-১৫ দিন পরপর স্প্রে করতে হবে।
জারা লেবুর ফলন: জারা লেবুর গাছ থেকে পাঁচ বছরেরও অধিক সময় পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়।
How useful was this post?
Click on a star to rate it!
We are sorry that this post was not useful for you!
Let us improve this post!
Thanks for your feedback!