About Us Contact Us Privacy Policy Terms & Conditions Copyright

নেপিয়ার ঘাস ( Napier grass ) চাষের আধুনিক পদ্ধতি এবং এর সতর্কতা

Please don't forget to share this article

নেপিয়ার ঘাস ( Napier grass ) চাষ পদ্ধতিঃ বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। দেশের প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ কোনো না কোনোভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। সেক্ষেত্রে হাল চাষের প্রয়োজনে অনেকেই গবাদিপশু পালন করে থাকে। আবার হালের বলদের সাথে অনেকেই ২/১টি গাভিও পালন করে থাকে। এসব গাভির অধিকাংশই দেশি এবং তাদের দুধ উৎপাদন মোটেই উল্লেখ্যযোগ্য নয়। তবু যতটুকু দুধ পাওয়া যায় তাঁরা তা বাজারে বিক্রি করে থাকেন। যদিও মুষ্টিমেয় কিছু সংখ্যক গাভি তুলনামূলকভাবে বেশি দুধ দেয় তারাও পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে দুধ উৎপাদন ক্ষমতা ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী একজন মানুষের দৈনিক ২০০ মিলিঃ দুধ খাওয়া প্রয়োজন। এদিক বিবেচনায় আমাদের দেশে দুধের উৎপাদন খুবই খারাপ বলা যায়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য দেশে দুধ উৎপাদনের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ অতীব জরুরি। তাছাড়া আমাদেরকে বছরে প্রায় ৪০০-৪৫০ কোটি টাকার দুধ বা দুগ্ধজাতপণ্য আমদানি করতে হয়। আমরা যদি দেশের গবাদি পশুর সঠিক পরিচর্যা ও উন্নয়নের মাধ্যমে দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারি তাহলে একদিকে যেমন কর্মসংস্থান বাড়বে অন্যদিকে তেমনি বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে।

নেপিয়ার ঘাস: দুধ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রথমেই জাতের উন্নয়ন আবশ্যক। তারপরই আসে খাদ্যের ভূমিকা। খাদ্যের মধ্যে কাঁচা ঘাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দুধ উৎপাদন বৃদ্ধিতে কাঁচা ঘাসের কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশ জনসংখ্যায় খুবই ঘন বসতিপূর্ণ এবং জমির পরিমাণ অল্প। তাই যেখানে মানুষের খাদ্য উৎপাদনেই নাভিশ্বাস উঠছে, সেখানে গবাদির জন্য খাদ্য উৎপাদন অনেকটা চ্যালেঞ্জের মুখে। তবুও যদি কৃষকভাইরা দেখেন যে ঘাস উৎপাদনের ফলে তাঁদের গাভির দুধ উৎপাদন বাড়ছে এবং এর লভ্যাংশ দ্বারা অন্যান্য খরচ মেটানো সম্ভব, তাহলে তাঁরা গবাদিপশু পালনের দিকে ঝুঁকে পড়বেন। আর কাঁচা ঘাস সহজ প্রাপ্য হলে গাভি পালনও সহজতর হবে। তাই আধুনিক পদ্ধতিতে ঘাস চাষ করতে হবে। সেজন্য দরকার ব্যাপকভাবে উচ্চ উৎপাদশীল ঘাস চাষ। কাজেই এ বিষয়ে কৃষক ভাইদের সচেতন করতে হবে।

আমরা আজকে এমনই একটি ঘাস চাষ নিয়ে আলোচনা করবো যার উৎপাদন যথেষ্ট পরিমাণে বেশি। বাংলাদেশের প্রায় সকল এলাকায় এ ঘাস জন্মানো সম্ভব এবং তা থেকে প্রায় সারা বছরই গবাদির কাঁচা ঘাসের চাহিদা পূরণ করা যেতে পারে। এই ঘাসটির নাম নেপিয়ার।

নেপিয়ার এক প্রকার স্থায়ী ঘাস। দেখতে আখের মত, লম্বা ৬.৫-১৩.০ ফুট বা তার চেয়েও বেশি হয়ে থাকে। এই ঘাস দ্রুত বধর্নশীল, সহজে জন্মে, পুষ্টিকর, সহজপাচ্য ও খরা সহিষ্ণু। একবার রোপন করলে ৩-৪ বছর পর্যন্ত এর ফলন পাওয়া যায়। শীতকালের ২-৩ মাস ছাড়া প্রায় সারা বছরই এর উৎপাদন অব্যাহত থাকে। এই ঘাস আবাদের জন্য উঁচু ও ঢালু জমি যেমন বাড়ির পার্শ্বে উঁচু অনাবাদি জমি, পুকুরের পাড়, রাস্তার ধার ও বেড়ীবাঁধ সবচেয়ে উত্তম। ডোবা, জলভূমি কিংবা প্লাবিত হয় এমন অঞ্চলে এই ঘাস আবাদ করা যায় না।

জমি নির্বাচনঃ পানি নিষ্কাশনের জন্য ভাল ব্যবস্থা আছে অর্থাৎ যেখানে বৃষ্টি বা বর্ষার পানি জমে থাকে না এরূপ জমি নেপিয়ার চাষের জন্য উত্তম। প্রায় সব ধরনের মাটিতেই এ ঘাস রোপন করা যায়, তবে বেলে-দোআঁশ মাটি সবচেয়ে বেশি উপযোগী।

চাষের সময়ঃ নেপিয়ার ঘাস সারা বছরই রোপণ করা যায়। সাধারণত বর্ষা মৌসুমেই রোপন করা ভালো। বর্ষার প্রারম্ভে এই ঘাসের কাটিং বা চারা রোপণ করা হয়। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে প্রথম বৃষ্টির পর জমিতে চারা বা কাটিং লাগালে প্রথম বছরেই ৩-৪ বার পর্যন্ত ঘাস কাটা যেতে পারে। চারা বা কাটিং লাগানোর পর যদি রৌদ্র হয় বা মাটিতে রস কম থাকে তাহলে চারার গোড়ায় পানি সেচ দিতে হবে।

জমিচাষ ও রোপন পদ্ধতিঃ সমতল জমিতে ৪-৫টি চাষ ও মই দিয়ে জমি আগাছামুক্ত করে কাটিং বা চারা লাগাতে হবে। এই ঘাস আখের কাটিং-এর মত কাটিং অর্থাৎ কান্ডের দুই মাথায় কমপক্ষে দু’টি বা তিনটি গিট রেখে কাটতে হবে। এক সারি হতে অন্য সারির দূরত্ব ৩৬ ইঞ্চি এবং এক চারা হতে অন্য চারার দূরত্ব ১৮ ইঞ্চি। কাটিং ৬-৮ ইঞ্চি গভীরে রোপন করা উচিত। একটি গিট মাটির নীচে, মধ্যের গিট মাটির সমানে রেখে চারা বা কাটিং অনুমানিক ৪৫০ কৌণিকভাবে লাগাতে হয়। সাধারণত জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রথম বৃষ্টির পর অথবা ভাদ্র মাসের শেষ ভাগে যখন বৃষ্টিপাত কম থাকে তখন নেপিয়ার ঘাস লাগানো উত্তম। অতি বৃষ্টিতে কাটিং লাগালে তা পচে যাবার সম্ভাবনা থাকে। মোথা লাগালে অনুরূপভাবে জমি তৈরি করে নির্দিষ্ট দূরত্বে গর্ত করে গর্তের মধ্যে একটি করে চারা লাগাতে হবে। সম্ভব হলে প্রতি গর্তে কিছু পচা গোবর বা মুরগীর বিষ্ঠা দেয়া উত্তম।

রাস্তা, পুকুরের বাঁধ বা পাহাড়ের ঢালু জমিতে নেপিয়ার চাষ করতে হলে প্রথমে ঢালের আগাছা কোদাল বা কাচি দ্বারা কেটে পরিষ্কার করতে হবে। এরপর নির্দিষ্ট দুরত্বে কোদাল দিয়ে ছোট ছোট গর্ত করে প্রতি গর্তে গোবর বা মুরগীর বিষ্ঠা এবং টিএসপি সার দিয়ে চারা লাগাতে হবে। চারা লাগিয়ে চার পাশ ভাল করে মাটি দিয়ে চেপে দিতে হবে যাতে চারার শিকড় মাটির সাথে লেগে থাকে।

সার ও পানি সেচ পদ্ধতিঃ উন্নত জাতের ঘাসের ফলন বেশি পেতে হলে জমিতে প্রয়োজন অনুসারে সার দিতে হয়। জমির গুণাগুণের উপর নির্ভর করে সার ও পানি সেচ দিতে হবে। বাংলাদেশে বর্ষার সময় ৫/৭ মাস পানি সেচের প্রয়োজন হয় না, শুধু খরার সময় পানির সেচের প্রয়োজন হয়। পচা গোবর ও ফার্মজাত আবর্জনা, পচানো ঘাস হেক্টর প্রতি প্রায় ৩০০০-৪০০০ কেজি জমি চাষের সময় ভালোভাবে ছিটিয়ে দিলে মাটিতে পুরোপুরি মিশে যায়। বেশি ফলন পেতে হলে এর সাথে হেক্টর প্রতি ২২৫ কেজি ইউরিয়া, ১৫০ কেজি টিএসপি এবং ৭৫ কেজি মিউরেট অব পটাশ প্রয়োগ করতে হবে। চারা রোপনের পর জমিতে চারা লেগে গেলে অর্থাৎ রোপনের প্রায় ১০-১২ দিন পর হেক্টর প্রতি ৮০ কেজি ইউরিয়া সার দিলে ভালো হয়। প্রত্যেক কাটিং-এর পর দুই সারির মাঝের জমি ভালোভাবে লাঙ্গল বা কোদাল দিয়ে মাটি আলগা করে হেক্টর প্রতি ৫০ কেজি ইউরিয়া সার দিলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। প্রথম কাটিং ৬০-৮০ দিনের মধ্যে পাওয়া যায়। বর্ষাকালে নেপিয়ারের উৎপাদন ভালো হয়। বছরে কমপক্ষে দু’বার (আষাঢ়-শ্রাবণ ও মাঘ-ফাল্গুন মাসে মাটি আলগা করে দিতে হবে। গ্রীষ্মকালে ১০-১২ দিন বিরতিতে এবং শীতকালে ১৫-২০ দিন বিরতিতে পানি সেচ দিলে আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায়।

সাথী ঘাস চাষঃ নেপিয়ার ঘাসের সঙ্গে শুটি চাষ করলে একদিকে যেমন জমির উর্বরতা বাড়ে অন্যদিকে ঘাসের পুষ্টিমাণও বৃদ্ধি পায়। স্থায়ী শুটি যেমন সেন্ট্রোসীমা, পয়রো, সিরাট্রো ইত্যাদি এবং অস্থায়ী শুটি যেমন বারসীম, কাউপি, মাসকলাই ও খেসারী ইত্যাদির চাষ করা যেতে পারে। দুই সারি নেপিয়ারের মাঝে এই ঘাসের চাষ করতে হয়।

ঘাস কাটার নিয়ম ও ফলনঃ কাটিং বা মোথা লাগানোর ৬০-৭০ দিন পর প্রথমবার ঘাস সংগ্রহ করা যায় এবং এর পর প্রতি ৬-৮ সপ্তাহ পরপর জমি হতে ঘাস সংগ্রহ করা যায়। মাটির ৫-৬ ইঞ্চি উপর থেকে ঘাস কাটতে হয়। প্রথম কাটিং-এ ফলন একটু কম হলেও দ্বিতীয় কাটিং থেকে পরবর্তী ২-৩ বছর পর্যন্ত ফলন বাড়তে থাকে। এরপর আস্তে আস্তে কমতে থাকে। ৪ থেকে ৪-১/২ বছর পর পুনরায় কাটিং বা মোথা লাগাতে হবে। বছরে প্রতি হেক্টরে ১৪০-১৮০ টনের মত ঘাস উৎপাদিত হয়। সাইলেজ করার ক্ষেত্রে ঘাসে ফুল ফোটার পূর্বে বা পর পরই কাটা ভাল। এতে খাদ্যমান বেশি থাকে।

খাওয়ানোর নিয়মঃ জমি থেকে ঘাস কাটার পর ঘাস যাতে শুকিয়ে না যায় সেদিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখতে হবে। আস্ত ঘাস গবাদিকে খেতে দিলে অপচয় বেশি হয়। তাই মেশিন, দা অথবা কাঁচি দ্বারা ২-৩ ইঞ্চি লম্বা করে কেটে খাওয়ানো ভাল। এই কাটা ঘাস খড়ের সাথে মিশিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে।

সংরক্ষণঃ নেপিয়ার ঘাস রৌদ্রে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা সুবিধাজনক নয়, তবে রাখা যেতে পারে। কাঁচা সবুজ ঘাস ছোট ছোট খন্ড বা টুকরা করে সাইলেজ আকারে সংরক্ষণ করাই উত্তম।

সাবধানতাঃ নেপিয়ারের জমিতে ইউরিয়া সার প্রয়োগের পর অনেক দিন খরা হলে ইউরিয়া হতে নাইট্রেট বা নাইট্রাইট ঘাসের মধ্যে উৎপন্ন হতে পারে এবং পরবর্তীতে অধিক বৃষ্টিপাত হওয়ার পর দ্রুত বেড়ে ওঠা এই ঘাস কেটে খাওয়ানো ঝুকিপূর্ণ। এতে বিষক্রিয়া হতে পারে।

নিম্নলিখিত সতর্কতা অবলম্বন করলে বিষক্রিয়ার প্রভাব থেকে গবাদিপশুকে মুক্ত রাখা যায়।

(১) জমিতে সার ছিটাবার ২ (দুই) সপ্তাহের মধ্যে ঘাস কাটা উচিত নয়।

(২) সার ছিটাবার পরে দীর্ঘ দিন খরা থাকার পর হঠাৎ অধিক বৃষ্টিপাতের পর দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া ঘাস কেটে খাওয়ানো উচিত নয়।

(৩) ঘাস কাটার একমাস পূর্বে সার ছিটানো যেতে পারে।

নেপিয়ার উচ্চ ফলনশীল ঘাস। এই ঘাস চাষের মাধ্যেমে গবাদিপশুর কাঁচা ঘাসের চাহিদা মিটানো সম্ভব। কাঁচা ঘাস/সাইলেজের ব্যবহার যথাযথভাবে করতে পারলে দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে যা দ্বারা ক্রমান্বয়ে দেশের দুধের চাহিদা মিটানো যাবে এবং এর ফলে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য আমদানির মাধ্যমে যে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে তা বহুল অংশে কমানো সম্ভব। বর্তমানে দুধের দাম যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে করে দুধ উৎপাদন বাড়লে কৃষকের যেমন আর্থিক স্বচ্ছলতা বৃদ্ধি পাবে তেমনি দেশের আর্থিক অবস্থারও উন্নতি ঘটবে।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

As you found this post useful...

Follow us on social media!

We are sorry that this post was not useful for you!

Let us improve this post!

Please don't forget to share this article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি। সকল স্বত্ব www.agriculturelearning.com কর্তৃক সংরক্ষিত