About Us Contact Us Privacy Policy Terms & Conditions Copyright

বাংলাদেশে সৌদি খেজুরের চাষ পদ্ধতি। বিভিন্ন জাত, বংশবিস্তার ও পরিচর্যা

Please don't forget to share this article

সৌদি আরবের খেজুর এবং খেজুরগাছের চারা এখন বাংলাদেশের মাটিতেই আবাদ হচ্ছে। এরই মধ্যে আগ্রহী চাষিরা  সৌদি খেজুরের বাগান গড়ে তুলেছেন। তা থেকে উৎপাদিত হচ্ছে অবিকল সৌদি খেজুর। বাংলাদেশের  আবহাওয়াতে উন্নত জাতের সৌদি খেজুর চাষ করা সম্ভব। কেননা বাংলাদেশের মাটি সৌদি খেজুর চাষের উপযোগী।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গাজীপুরের ভাওয়াল এলাকার এক চাষির কথা। তিনি মুক্তিযোদ্ধা জিল্লুর রহমানের ছেলে নজরুল ইসলাম বাদল। বাদল জানান, ২০১৪ সালে ১৮টি চারা গাছ সংগ্রহ করে ১০ কাঠা জমি নিয়ে প্রথমে বাগান শুরু করেন। চারা উৎপাদনে তিনি ‘সৌদি ডেট পাম ট্রিস ইন বাংলাদেশ’ নামে একটি নার্সারি গড়েছেন। এর মধ্যে সৌদি আরব থেকে তিনটি, দুবাই থেকে ১০টি, ভারত থেকে দুটি ও কুয়েত থেকে দুই বছর বয়সী তিনটি চারা বিভিন্ন মাধ্যমে সংগ্রহ করেন। ১৮ টি চারা ক্রয় করতে সাত লাখ ২০ হাজার টাকা লেগেছিল।

বর্তমানে তার বাগানে বড় ১১টি ও মাঝারি সাইজের মোট ৩০০টি গাছে খেজুর ধরেছে এবং ছয়টি জাতের খেজুর চারা রয়েছে। এর মধ্যে আজওয়া, আনবারা, সুক্কারি, রুথান, বারহি ও মরিয়ম জাতের চারা রয়েছে। বাদল জানান, তার খেজুর বাগানে এখন আঁকার ভেদে বিভিন্ন দামের চারা গাছ রয়েছে। খেজুর ধরা গাছের দাম এক লাখ টাকা, তিন বছর বয়সী চারা পাঁচ হাজার টাকা।  এছাড়াও এক বছর বয়সী চারার দাম দুই হাজার টাকা এবং এক কেজি চারা উৎপাদনযোগ্য খেজুরের দাম চার হাজার টাকা। সব মিলিয়ে তিনি ৫০ লাখের বেশি টাকার চারা বিক্রি করেছেন বাগান শুরুর পর থেকে। তিনি আগ্রহীদের সৌদি খেজুর চাষের প্রশিক্ষণ দেওয়া ছাড়াও মানুষকে খেজুর বাগান করার নিয়ম সম্পর্কে সব ধরনের তথ্য দিয়ে থাকেন।

এছাড়াও বলা যায়, ময়মনসিংহের মো. মোতালেব হোসেনের কথা যিনি ভালুকাতে ২০০৬ সাল থেকে অর্থাৎ বিগত নয় বছর ধরে সৌদি খেজুরের চাষ করে আসছেন। বর্তমানে তার বাগানে রয়েছে ২০টির মতো খেজুর গাছ। তিনি এক একটা গাছ থেকে বছরে ৪৫ কেজি করে খেজুর পাচ্ছেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ( ডিএই ) এর ভূমিকাঃ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, সরকারিভাবে প্রথম সৌদি থেকে উন্নত জাতের খেজুর কলম আমদানি করে বিভিন্ন জেলার হর্টিকালচার সেন্টারগুলোতে সৌদি খেজুরের বাগান সৃষ্টি করার উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে কিছু সংখ্যক গাছ ফুল ধরা অবস্থায় ফেব্রুয়ারী ২০১৭ তে এনে তাতে ফল ধরা আরম্ভ করেছে। এ পর্যন্ত মে,২০১৭ মাস পর্যন্ত মোট ৬২৫ টা বিভিন্ন উন্নত ১৫ জাতের খেজুর গাছ আমদানি করে বাংলাদেশের ২৫ টা হর্টিকালচার সেন্টারে এবং ২৫ জন আগ্রহী কৃষকের জমিতে সৌদি খেজুরের চাষ পরিকল্পিত ভাবে শুরু করা হয়েছে। অচিরেই বাংলাদেশ সৌদি খেজুর উৎপাদনে সফলতা অবশ্যই অর্জন করবে।

আবহাওয়া ও মাটি : পর্যাপ্ত রোদ, কম আর্দ্রতা, শুকনা ও কম বৃষ্টিপাত, উষ্ণ আবহাওয়া এ ফল চাষের জন্য উপযোগী। বেশি শীত এবং সাময়িক জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ত সহিষ্ণু গুণাগুণ এ গাছের আছে। ফুল ফোটা ও ফল ধরার সময় বেশি বৃষ্টিপাত ভালো না। একই কারণে এ দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলীয় এবং পার্বত্য জেলাগুলোতে সৌদি খেজুর চাষ সম্প্রসারণ করার সুযোগ আছে। বেলে-দো-আঁশ মাটি এ জাতের খেজুর চাষের জন্য বেশি উপযোগী। তবে মাটি অনুকূল না হলে রোপণের আগে গর্তের মাপ ( ৬X৬X৩ ) তৈরি করে তাতে জৈবপদার্থ ও বেলে মাটি দিয়ে তা ভরাট করে নিয়ে খুব সহজেই মাটিকে উপযোগী করে নেয়া যায়। পানি নিকাশের সুবিধাযুক্ত উচ্চ জমি এ ফল চাষের জন্য উপযোগী।

পুষ্টিমান : খেজুর অতি পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ ফল। এতে প্রচুর প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেলস ও ক্যালোরি সমৃদ্ধ। সুষম খাদ্য হিসেবে খেজুরের জুড়ি নেই। এ ফলের ঔষধিগুণ খুব বেশি। এটি হজম শক্তি বাড়ানোসহ রক্ত স্বল্পতা, কোষ্ঠকাঠিন্য, এলার্জি ও ক্যান্সার রোধক হিসেবে কাজ করে। খেজুর দেহে শক্তি জোগায়, হার্টকে সুস্থ রাখে, দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করে, দেহের হাড় ও দাঁতকে মজবুত রাখে। রক্তশূন্যতা, গলাব্যথা, ডায়রিয়া, সুস্থ গর্ভধারণে এ ফল অতি উপকারী।

জাতঃ পৃথিবীতে প্রায় এক হাজারের বেশি খেজুরের জাত রয়েছে। সৌদি দেশগুলোতেই এ জাতের সংখ্যা চার শতাধিক। যেহেতু তাল ও লটকন গাছের মতো খেজুরের পুরুষ-স্ত্রী গাছ আলাদাভাবে জন্মায়, এজন্য বীজ থেকে তৈরি গাছে প্রাকৃতিকভাবে নতুন জাতের সৃষ্টি হয়। তবে বীজ থেকে তৈরি চারায় প্রকৃত জাতের গুণাগুণ থাকে না। ফল ধরতে বেশি সময় লাগে, ফলের পরিমাণ ও মান আশাপদ হয় না। যেসব জাতের খেজুরের জনপ্রিয়তা বেশি এগুলোর মধ্যে বারহি, মেডজল, সামরান, খাতরাই, জাহেদি, খালাস, মরিয়ম, নিমেশি, আনবারাহ, জাম্বেলি, শিশি, লুলু, সুলতানা, আজুয়া, ইয়াবনি, ডিগলিটনূর, আসমাউলহাসনা অন্যতম। ডিএই এ পর্যন্ত ১৭টি আধুনিক উন্নত জাতের খেজুর কলম আমদানি করে বিভিন্ন জেলার হটিকালচার সেন্টারে বাগান সৃষ্টি করছে।

বংশবিস্তার : আরব দেশগুলো আগে পছন্দমতো জাতের কাণ্ড থেকে গজানো সাকার বা চারা সংগ্রহ করে তা দিয়ে বাগান সৃষ্টি করতেন। এছাড়া বীজের চারা দিয়েও খেজুর বাগান সৃষ্টি করার প্রচলন ছিল। তবে অধুনা টিস্যুকালচার পদ্ধতি অবলম্বনে উন্নত জাতগুলোর প্রচুর কলম তৈরি করে তা ব্যবহার জনপ্রিয়তা বেড়ে চলেছে। পুরনো পদ্ধতিতে কা- থেকে চারা কম পাওয়া যেত। বীজ থেকে তৈরি চারার গাছে ফল দিতে প্রায় ৬ বছর সময় লাগে। খেজুর গাছের কাণ্ড থেকে প্রাপ্ত চারা এবং টিস্যুকালচারের মাধ্যমে তৈরি চারা রোপণের ৩ বছর পর থেকেই গাছে ফুলফল ধরা শুরু হয়। এখন টিস্যুকালচারের মাধ্যমে খেজুর চারা উৎপাদন কাজে কিছু প্রতিষ্ঠান নিয়োজিত থাকার কারণে উন্নত জাতের বাগান সৃষ্টি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অন্যান্য দেশগুলোও এর সুফল ভোগ করছে। এ দেশে ১৫-২০ বছর ধরে অনেকেই সীমিত আকারে খেজুর চাষ করছে তা বীজের তৈরি চারা দিয়ে, এতে ভালো জাতের প্রকৃত গুণাগুণ বজায় থাকে না, ফলের মান ও ফলন ভালো হয় না।

জমি নির্বাচন ও রোপণ : পানি নিষ্কাশন সুবিধাযুক্ত অপেক্ষাকৃত উঁচু প্রচুর আলো-বাতাস পায় এমন জমি খেজুর বাগানের জন্য নির্বাচন করা দরকার। বাগান তৈরির জন্য ২০ ফুট দূরত্বে সারি করে ২০ ফুট দূরে দূরে চারা রোপণের জন্য খেজুর বাগান নকশা তৈরি করে নেয়া প্রয়োজন। এক বা দুই সারি গাছ লাগানোর প্রয়োজনে ১৫-১৭ ফুট দূরত্ব দিলেই চলবে। বর্ষাকালে ১০-১২ ইঞ্চি পানি জমে থাকে এমন নিচু স্যাঁতসেঁতে জমিতে সর্জান পদ্ধতি অবলম্বনে বাগান সৃষ্টি করা সহজ। এ ক্ষেত্রে দুই সারির মাঝে ৭-৮ ফুট চওড়া এবং ২-৪ ফুট গভীর নালা কেটে উভয় পাশে গর্তের মাটি উঠিয়ে দিয়ে ১০-১২ ফুট চওড়া উঁচু বেড তৈরি করে নিয়ে সে বেডে খুব সহজেই সফলভাবে খেজুর বাগান সৃষ্টি করা যায়। বরিশাল জেলার রহমতপুর হর্টিকালচার সেন্টারে এ পদ্ধতি অবলম্বনে ৭২টি খেজুর গাছ বিশিষ্ট খেজুর বাগান সৃষ্টি করা হয়েছে। এ বাগানের গাছের বাড়-বাড়ন্ত খুব উৎসাহজনক, যা আগামী দিনে উপকূলীয় জেলাগুলোতে আরবি খেজুর চাষ সম্প্রসারণে উল্লেখযোগ্য মডেল হিসেবে কাজ করবে।

গর্ত তৈরি ও  ভরাটকরণঃ রোপিত গাছের শিকড় যেন ঠিকমতো ছড়াতে পারে এজন্য ৬ ফুট চওড়া ও ৩ ফুট গভীর করে গর্ত তৈরি করে নিয়ে তা এক সপ্তাহ রোদে রেখে গর্তে সার ও মাটি দিয়ে পুনরায় ভরাট করে নেয়া প্রয়োজন। তৈরিকৃত গর্তে খড়কুটা দিয়ে ভরাট করে তা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিলে গর্তের মাটি শোধন করা যাবে। খেজুর চারা রোপণের আগে যেসব সার ও উপাদান মিশানো প্রয়োজন তা হলো মোটাবালু (সিলেট স্যান্ড) ৩০%, পচা গোবর বা আবর্জনা পচা সার ৪০% এবং ভিটে মাটি বা বেলে দো-আঁশ মাটি ৩০%। এছাড়াও এতে আরও মেশাতে হবে ১০-১৫ কেজি কোকোডাস্ট বা নারিকেলের ছোবড়ার গুঁড়া, সমপরিমাণ কেঁচো সার। হাড়ের গুঁড়া ১ কেজি, ইউরিয়া-৩০০ গ্রাম, টিএসপি-৪০০ গ্রাম, এমওপি-৫০০ গ্রাম। এছাড়া জিঙ্ক সালফেট, ম্যাগসালফেট, ফেরাস সালফেটে ও বোরন- প্রতি গাছে ১০০ গ্রাম করে মোট ৪০০ গ্রাম মেশানো প্রয়োজন। রোগবালাই প্রতিহত করার জন্য উপযোগী ছত্রাক নাশক ও দানাদার কীটনাশক ১০০ গ্রাম করে মোট ২০০ গ্রাম মেশাতে হবে। এসব একত্রে মিশেয়ে গর্ত ভরে পানি দিয়ে কয়েক দিন ভিজিয়ে রাখতে হবে। এভাবে গর্ত ভরাট করার দুই সপ্তাহ পর তা গাছ রোপণের জন্য উপযোগী হবে।

চারা রোপনঃ খেজুরের চারা সমতল থেকে এক ফুট ওপরে রোপণ করতে হবে। এজন্য গর্ত ভরাট করা মাটি উঠিয়ে মধ্যভাগ উঁচু করে নিতে হবে। এরপর ক্রমান্বয়ে তা বাইরের দিক ঢালু করে নালা বরাবর মিলাতে হবে। গাছ রোপণ করা হলে গাছের গোড়া থেকে ২.৫ ফুট দূরে বৃত্তাকার করে ১০-১২ ইঞ্চি চওড়া ও ১২ ইঞ্চি গভীর নালা তৈরি করে এ নালার মাটি বাইরের দিক সুন্দরভাবে বৃত্তাকারে উঁচু আইল বেঁধে দিতে হবে। গাছ রোপণ শেষে নালায় ৮-১০ দিনের ব্যবধানে পানি দিয়ে নালা ভর্তি করে দিতে হবে। গাছ এ নালার পানি শুষে নেবে।

গাছে ফুল ও ফল ধরার সময়ঃ সাধারণত সৌদি খেজুর গাছে ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে ফুল ধরে এবং জুলাই-আগস্ট মাসে ফল পাকে।

পানি নিষ্কাশন ও সেচ: বর্ষাকলে যেন বাগানে কোন মতেই পানি না জমে এ জন্য পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা রাখতে হবে। খরা মৌসুমে নিয়মিত গাছের গোড়ার চারধারে পানি সেচ দিয়ে ভাল ভাবে ভেজাতে হবে। মাটিতে রসের অবস্থা বুঝে ৭-১৫ দিনের ব্যবধানে নালা ভর্তি করে পানি সেচ দিয়ে গাছের প্রয়োজনীয় রসের অভাব দূর করতে হবে। ভালভাবে গাছের বৃদ্ধি, বেশি উন্নত মানের ফল প্রাপ্তি, প্রয়োজনীয় পানি সেচ ও নিস্কাশন ব্যবস্থার উপর অনেকটা নির্ভর করে। বয়স্ক খেজুর গাছের শিকড় গোড়া থেকে প্রায় ৪-৫ ফুট বৃত্তাকারে চারদিকে ৩-৪ ফুট গভীরতায় প্রবেশ করে। এ জন্য শুকনা মৌসুমে এ শিকড় ছড়ানো এলাকায় রসের অভাব দূরীকরণের ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

মালচিং ও ট্রেনিংপ্রুনিং: শুকনা মৌসুমে গাছের গোড়ার চারধারে ২-৩ ফুট দূর পর্যন্ত বৃত্তাকারে খড়, লতাপাতা বা কচুরিপানা দিয়ে মালচিং দিতে হবে। তাতে মাটির রস সংরক্ষিত থাকে এতে ঘন ঘন সেচ দেয়ার প্রয়োজন হবে না। মালচিং দেয়ার ফলে গাছের গোড়ার চারদিক আগাছামুক্ত থাকবে, পরিবেশ অনুকূল হবে, পরে এসব লতা-পাতা পচে জৈবসার হিসেবে কাজ করবে। গাছ বড় হলে উপরি ঊর্ধ্বমুখী গাছের পাতা রেখে নিচে ঝুলে পড়া পুরনো মরা পাতাগুলো কাণ্ডের গোড়া থেকে ৭-৮ ইঞ্চি ছেড়ে ছেঁটে দেয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়াও উপরের দিকের অফলন্ত ফলের ছড়া ও ফুল-ফলের শক্ত ঢাকনা সাবধানে অপসারণ করতে হবে। সাথে সাথে কাটা অংশে ছত্রাকনাশক বা বোর্দ মিক্সার পেস্ট দিয়ে প্রলেপ দেয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে।

পরিচর্যা : গাছ রোপণ করে তা কাঠি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে সম্ভাব্য সোজা রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রথম কয়েক বছর পাতা শুকালে তা কেটে দিতে হবে। কোন মতেই গাছের কাঁচা পাতা কাটা যাবে না। তবে বছরে একবার ফল সংগ্রহ শেষে নিচের দিকে ঝুলে পড়া বয়স্ক অপ্রয়োজনীয় পাতা অপসারণ করতে হবে। গাছের গোড়া ও কা- থেকে গজানো শাখা বাড়তে দিলে গাছে ফলদান ক্ষমতা কমে যাবে। তবে চারা সংগ্রহের প্রয়োজনে গোড়ার কাছাকাছি গজানো কিছু সাকার রেখে অবশিষ্ট সাকারগুলো নিয়মিত ছেঁটে দিতে হবে। সংগৃহীত চারা বেশি ছায়ায় সংরক্ষিত থাকার কারণে চারা রোপণের পর সূর্যের তাপে খেজুর চারা ঝলসে না যায় এজন্য রোপণের প্রথম ১০-১৫ দিন উত্তর-পূর্ব দিক উন্মুক্ত রেখে পাতলা ছালা দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক ভালোভাবে ঢেকে দিয়ে গাছকে হালকা ছায়া দেয়া প্রয়োজন হবে। বিকল্প ব্যবস্থায় গাছগুলোকে ১৮ ইঞ্চি বিশিষ্ট মাটির টবে উপযোগী পটিং মিডিয়া দিয়ে আধাছায়ায় ২-৩ মাস সংরক্ষণ করে পরে সেগুলো বাগানে রোপণ উপযোগী হবে।

সার প্রয়োগ : আরবি খেজুর গাছে ৪ মাসের ব্যবধানে নিয়মিত সার প্রয়োগ করা জরুরি। তাতে গাছ ভালোভাবে বাড়বে, বেশি ফল দানে সক্ষম হবে। নারিকেল, সুপারির মতো এরা পামী গোত্রীয় বলে পটাশ পছন্দ করে। বিভিন্ন বয়সের গাছে যে সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন তা হলো-

ক্রমিক নং সারের প্রকার গাছের বয়স
১ম বছর ২য় বছর ও তৃতীয় বছর ৪র্থ ও ৫ম বছর ৬ বছরের উর্দ্ধে
১। গোবর/আবর্জনা পাঁচা সার (কেজি) ১০-১৫ ২০-২৫ ৩০-৪০ ৫০-৬০
২। হাঁড়ের গুড়া ( কেজি) ১১-১২ ২১-২২ ৩২-৩৩ ৪১-৪২
৩। ইউরিয়া ( গ্রাম) ৫০০-৭০০ ৮০০-১০০০ ১২০০-১৫০০ ২০০০-২৫০০
৪। টিএসপি ( গ্রাম) ৪০০-৫০০ ৬০০-৭০০ ৮০০-৯০০ ১০০০-১২০০
৫। এমওপি ( গ্রাম) ৭৫০-৮০০ ১০০০-১৫০০ ১৭০০-২০০০ ২০০০-৩০০০

 

প্রতি বছরের জন্য সুপারিশকৃত সারগুলো ৩ ভাগে ভাগ করে নিয়ে প্রতি ডোজ মে-জুন মাসে একবার এবং সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে ও ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে আরও দুইবার প্রয়োগ করা যেতে পারে। এছাড়াও অনু খাদ্যগুলো বিশেষ করে জিঙ্কসালফেট, ম্যাগসালফেট, ফেরাল সালফেট ও বোরন ও আইরোল বছরে একবার করে গাছের বয়স বিবেচনায় প্রতিষ্ঠাতে ২০০-৩০০ গ্রাম করে প্রয়োগ করা প্রয়োজন। সার প্রয়োগ করার পরপরই ভালোভাবে সেচ দিতে হবে। গাছের গোড়া ছেড়ে যে অংশে শিকড় ছড়ায় সে অংশে সার প্রয়োগ ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যেন সার প্রয়োগকালে গাছের শিকড় কম আঘাতপ্রাপ্ত হয়। ভালো ব্যান্ডের ঘচক বা ঘচকঝ মিশ্র সার ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে গাছের প্রথম অবস্থার তুলনায় নাইট্রোজেন জাতীয় সার প্রয়োগ কিছু বেশি প্রয়োজন হয়। ফুল-ফল ধরা আরম্ভ করলে পটাশ ও ফসফরাসের পরিমাণ বাড়াতে হবে। অনেকে অনুখাদ্যসমৃদ্ধ কোনো কোনো সার পানিতে গুলে যায় এমন সার প্রয়োগ করে গাছকে সুস্থ রাখে।

খেজুর গাছে পরাগায়ন: তাল, লটকন ফল গাছের মত খেজুর গাছের পুরুষ ও স্ত্রী গাছ আলাদা ভাবে জন্মে (ডায়োয়সিয়াস)। এ জন্য সুস্থ, বড় ও ভাল মানের খেজুর ফল প্রাপ্তির লক্ষ্যে সময়মত ফুটন্ত স্ত্রী ফুলের ছড়া বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরুষ গাছ থেকে সংগৃহীত পরাগ রেনু দিয়ে সময় মত পরাগায়ন করা অত্যাবশ্যক। প্রথমত: সুস্থ সবল বড় আকারের পুরুষ গাছ ফুল দানে সক্ষম এমন গাছ থেকে পুরুষ ফুল সংগ্রহ করে সাধারণ ফ্রিজে (২০-৪০ সেলসিয়াস তাপমাত্রায়) সংরক্ষণ করা হলে তা দু’ বছর পর্যন্ত পরাগায়নের কাজে ব্যবহার করা হয। সৌদি খেজুর গাছে প্রধাণত: জানুয়ারী-মার্চ মাসে ফুল ফুটে। উভয় প্রকার ফুলের কাঁদি একটা শক্ত আবরণ দিয়ে সুন্দর ভাবে ঢাকা থাকে। শুরু থেকে ফুল ফোটার স্তরে পৌঁছতে প্রায় এক মাস সময় লাগে। আবরণের ভিতরে ফুল বড় হয়ে পরাগায়নের উপযোগী হলে বাইরের আবরণটা আস্তে আস্তে ফাটা শুরু হয়। এ অবস্থায় পুরুষ ফুলের কাদিটা ধারালো ছুরি বা সিকেচার দিয়ে অপসারণ করে নিয়ে খুব সাবধানে হালকা রোদে শুকিয়ে নিয়ে এ পরাগ রেনু (পাউডারের মত অতি ক্ষুদ্র কণা) সাবধানে আলাদা করে নিয়ে কাগজে মুড়িয়ে তা পলিথিন কভার দিয়ে ফ্রিজের নরমাল চেম্বারে সংরক্ষণ করতে হয়।
এরপর স্ত্রী খেজুর গাছের ফুলের কাঁদি বড় হয়ে বাইরের শক্ত আবরণে ফাটল ধরা আরম্ভ করলে তা পরাগায়ন করার উপযোগী হয়। এ সময় ফাটল ধরা শক্ত আবরণ ধারালো ছুরি দিয়ে অপসারণ করে ছড়ার ভিতরের অংশ বের করে দামী নরম তুলি বা ব্রাশ দিয়ে সামান্য পরিমাণ পাউডারী পরাগ রেনু দিয়ে পরম আদরে স্ত্রী ফুলে এ পরাগ রেনু হালকা ভাবে ছুয়ে বা ঝেড়ে দিতে হয়। এছাড়া পুরুষ ফুলের দু’একটা ছাড়া স্ত্রী ফুলের আগায় বেধে রাখতে হয়। পরে ৫-৭ দিনের ব্যবধানে আরও দু’এক বার এ পরাগায়ন কাজ অব্যাহত রাখতে হয়। পরাগায়ন করা ফুলের ছড়া পাতলা ব্রাউন কাগজের ঠোঙ্গা দিয়ে হালকা ভাবে ঢেকে দিতে হয়। এর ৩-৪ সপ্তাহ পর আবরণটা সরিয়ে ফেলতে হয়। পরাগায়ন কালে ছড়ার কাছাকাছি খেজুরের ছুঁচালো কাঁটাগুলো সিকেচার দিয়ে অপসারণ করে নিলে কাঁটার আঘাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। কয়েক দশক আগে কৃত্রিম উপায়ে পরাগায়ন করার প্রচলন খুব কম ছিল। বাগানে আনুমানিক হারে (প্রতি ১৫-২০ টা স্ত্রী গাছের জন্য একটা করে) পুরুষ গাছ রাখার কারণে বাতাসের ও মৌমাছি বা উপকারী কীট পতঙ্গের মাধ্যমে পরাগায়ন কাজ সমধা হতো। এতে ৬০-৮০ % ফল ধরানো সম্ভব হতো।

পোকা ও রোগ দমন: নারিকেল, তাল ও খেজুর গাছের শিকড়ের অগ্রভাগ নরম ও মিষ্টি যা উই পোকাসহ মাটিতে অবস্থানকারী বিভিন্ন পোকা ও নিমাটোডকে আকৃষ্ট করে। এ জন্য মাটিতে ব্যবহার উপযোগী দানাদার কীটনাশক ও তরল কীটনাশক (ইমিডাক্লোরোপিড/ডার্সবান) দু’তিন মাসের ব্যবধানে নিয়মিত ব্যবহার করে মাটিতে অবস্থান কারী পোকা দমন ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া নারিকেল গাছের মত খেজুর গাছেও রাইনো বিটেল (গন্ডার পোকা), রেড উইভিল স্কেল পোকার উপদ্রব বেশি দেখা যায়। এ জন্য বাগান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা এবং ইমিডাক্লোরোপিড অথবা ক্লোরোপাইরীফস দলীয় কীটনাশক দিয়ে ২-৩ সপ্তাহের ব্যবধানে কচি পাতা ও পাতার গোড়ার অংশ ভালভাবে স্প্রে করে ভেজানো হলে এ সব পোকার উপদ্রব থেকে গাছকে রক্ষা করা যাবে। খেজুর গাছে মাইটের উপদ্রব মাঝে মাঝে দেখা যায়। এ জন্য ২-৩ সপ্তাহের ব্যবধানে মাইট নাশক ব্যবহার করে গাছকে সুস্থ রাখা উচিত হবে।

রোগ: মাটিতে অবস্থানকারী ছত্রাক, প্রুনিং করার কারণে ক্ষত স্থানে রোগ এবং গজানো পাতার সমগ্র অংশে কাল/বাদামী দাগ পড়া রোগের আক্রমণ খেজুর গাছে বেশি দেখা যায়। এ জন্য ম্যানকোজেভ/ কার্বোন্ডাজিম দলীয় বা বোর্দর্ মিক্সচার দিয়ে ছত্রাক নাশক দিয়ে ১০-১৫ দিনের ব্যবধানে নিয়মিত পাতা,কান্ড ও মাটিতে স্প্রে করে গাছকে সুস্থ রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে।

ফল সংগ্রহ: পরাগায়ন করার ৩-৪ মাস পর খেজুর ফল সংগ্রহের উপযোগী হয়। কতগুলো জাতের পুষ্ট কাঁচা-পাকা ফল উভয় অবস্থায় খাওয়া যায়। অন্য জাতের ফল পরিপক্ক অবস্থায় বাদামী গাঢ় বাদামী/কাল রং ধারন করলে তা সংগ্রহ, সংরক্ষণ বা প্রক্রিয়াজাত করে ব্যবহার বা বাজারজাত করা হয়। একটা সুস্থ সবল গাছ থেকে বছরে জাত ভেদে ৭০-১৫০ কেজি খেজুর ফল পাওয়া যায়। পরাগায়নের পর ৭-৯ টা সুস্থ সবল কাঁদি রেখে অবশিষ্ট কাঁদিগুলো শুরুতেই অপসারণ করা দরকার। এ ব্যবস্থায় অবশিষ্ট কাঁদিগুলো থেকে বেশি আকর্ষণীয় বড় আকারের ফল পাওয়া নিশ্চিত হবে। খেজুর ফল ধীরে ধীরে বড় হওয়া আরম্ভ করলে তা ফলের ভারে ঝুলে পড়ে। এ ফলন্ত ছড়া পাতার ডগায় বাঁধাপ্রাপ্ত হয়ে ফল বড় হতে বাধা সৃষ্টি করে, তাতে ফলন কমে যায়। খেজুর ফলের থোকা যেন অবাধে আংশিক ভাবে ঝুলতে পারে এ জন্য কাঁটা পরিষ্কার করে দিয়ে ফলকে অবাধে বাড়তে দেয়া দরকার। খেজুরের ভারে একেকটা কাঁদি যেন ভেঙ্গে না পড়ে এ জন্য কাঁদির ফুল ধরা শুরু অংশে হালকা ভাবে দড়ি বেঁধে দিয়ে ফলের কাঁদিকে ভেঙ্গে যাওয়া বা বেশি ঝুলে পড়া রোধ ব্যবস্থা নিতে হয়। ফল কিছুটা বড় হলে এক ধরনের মাছি পোকা ও পাখির উপদ্রব বাড়তে থাকে। এ জন্য ঘন মশারী দিয়ে ঢিলা ব্যাগ তৈরী করে ফলগুলোকে সুন্দরভাবে ঢেকে দিতে হয়।

পরিশেষে বলা যায়, সৌদি খেজুর বাগানের বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনাময়। খেজুরগাছ ১০০ বছরের বেশি সময় ফলন দেয়। আর এ ক্ষেত্রে উৎপাদন খরচও কম। আমাদের দেশে খেজুরের চাহিদা রয়েছে ৩০ হাজার টন। বিশাল এই চাহিদার  অনেকাংশই পূরণ করা যেতে পারে দেশে সৌদি খেজুর গাছের চাষ করে। এতে করে  আমরা রফতানি করতে না পারলেও দেশের চাহিদা পূরণ করতে পারব বলে আশা করা যায়।

 

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

As you found this post useful...

Follow us on social media!

We are sorry that this post was not useful for you!

Let us improve this post!

Please don't forget to share this article

3 thoughts on “বাংলাদেশে সৌদি খেজুরের চাষ পদ্ধতি। বিভিন্ন জাত, বংশবিস্তার ও পরিচর্যা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি। সকল স্বত্ব www.agriculturelearning.com কর্তৃক সংরক্ষিত