About Us Contact Us Privacy Policy Terms & Conditions Copyright

স্টার আপেল চাষ পদ্ধতি এবং বাংলাদেশে এর অপার সম্ভাবনা

Please don't forget to share this article

স্টার আপেল গ্রীস্মমণ্ডলীয় ফল। এর বৈজ্ঞানিক নাম Chrysophyllum cainito L.। এটি মূলত সফেদা গোত্রের একটি সুস্বাদু ফল। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিদ্যমান দুর্লভ গাছসমূহের মধ্যে একটি হলো স্টার আপেল। এর কয়েকটি গাছ রয়েছে কৃষি অনুষদের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের সামনে। গাছগুলো বেশ বড়। সবুজ আপেলের মতো ফল ধরে। ফলগুলো পাকলে হাল্কা বেগুনি রং ধারন করে। ফলের ভিতরে মাঝে সাদা এবং চারপাশে উজ্জ্বল বেগুনি রং বিদ্যমান। ফলের ভিতরে চারটি বিচি থাকে, দেখতে গাবের বিচির মতো, তবে আকারে অনেক ছোট। ফলটি মিষ্টি স্বাদযুক্ত এবং খেতে বেশ সুস্বাদু। ফলের স্বাদ সুনির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। কখনো গাব কিংবা সফেদার স্বাদের মতো মনে হয়।

নামকরণঃ স্পেনে এটাকে কাইমিটা বা এস্টেরেলা, ওয়েস্ট ইন্ডিজে পোম সুরেট, বারবাডোজে স্টার পাম, কলম্বিয়াতে কাইমো, আর্জেন্টিনাতে আগুয়ে বা অলিভোয়া, চীন বা সিঙ্গাপুরে এটাকে চিকল ডুরিয়ান বলা হয়। তবে এর ভেতরের বীজগুলো ও পাল্প স্টার এর মতো থাকায় সাধারণভাবে এটাকে স্টার আপেল বলা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের আবহাওয়ায় এটি ভালোভাবেই অভিযোজিত।

উৎপত্তি ও বিস্তারঃ সাধারণভাবে স্টার আপেল সেন্ট্রাল আমেরিকার ফল বলা হলেও এ নিয়ে মতভেদ আছে। কারও মতে এর উৎপত্তি মেক্সিকো ও পানামা অথবা ওয়েস্ট ইন্ডিজ। গুয়াতেমালা, উত্তর আর্জেন্টিনা, পেরু, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুজ, বারমুদা, হাইতি, যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা ও হাওয়াই প্রভতি অঞ্চলে বর্তমানে স্টার আপেল চাষ হয়।

গাছের বৈশিষ্ট্যঃ স্টার আপেল গাছ বৃহৎ আকারের শোভাময়ী বৃক্ষ। উচ্চতা সাধারণত ৮-৩০ মিটার, কা- ১-৩ মিটার, বাদামি রোমশ এবং শাখা কাটলে সাদা কষ বের হয়। পাতা দোরঙা। অর্থাৎ ওপরের পিঠ গাড় সবুজ ও নিচের পিঠ মেরুন বাদামি। পাতা কিছুটা ডিম্বকার, বর্শার ফলার মতো। এই গাঢ় সবুজ চর্মবৎ পাতার নিচের দিক খয়েরী রঙের সুক্ষ রোমযুক্ত। পাতা ৫-১০ সেমি. লম্বা ও ৪-১০ সেমি. চওড়া হয়ে থাকে। পত্র কক্ষে ছোট গুচ্ছে সবুজাভ হলুদ বর্ণের ফুল উৎপন্ন হয় যাতে ৫টি দল থাকে।

ফল গোলাকার কখনো সামান্য লম্বাটে, ৫-১০ সেমি. লম্বা এবং ৫-১০ সেমি. ব্যাসযুক্ত সবুজ থেকে বেগুনি বর্ণের হয়ে থাকে। ফলের ভিতরে নরম জিলেটিনযুক্ত দুগ্ধবৎ সাদা মিষ্টি স্বাদযুক্ত পরস্পর সংযুক্ত ৬-১১টি কোষ থাকে যা কেন্দ্রীয় অক্ষের চতুর্দিকে ঘনসন্নিবিষ্ট থাকে। আড়াআড়ি কাটলে এটা এ স্টার বা তারার মতো দেখায় বলে সম্ভবত এ ফলটিতে স্টার আপেল বলা হয়।

আবহাওয়া ও মাটিঃ স্টার আপেল ট্রপিক্যাল বা সাব ট্রপিক্যাল অঞ্চলে এলাকায় ৪২০ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত জন্মাতে দেখা যায়। গরম আবহাওয়ায় এটা ভালো জন্মে। তাপমাত্রা হিমাংকের বা তার নিচে নেমে গেলে এ গাছ মারা যায়। স্টার আপেল যে কোন ধরনের সুনিষ্কাশিত গভীরতা সম্পন্ন বেলে থেকে এঁটেল মাটিতে চাষ করা যেতে পারে।

জাতঃ স্টার আপেল এর ফলত্বকের রং অনুযায়ী দুই ধরনের জাত দেখা যায়। একটি সবুজ ও অন্যটি বেগুনি রঙের হয়ে থাকে। ভালো ফল ধরে এমন গাছ থেকে অঙ্গজ উপায়ে তৈরিকৃত কলম লাগানো ভালো। শাখা কলমের চারা ২-৪ বছর পর অপরদিকে বীজ এর চারায় ৭-১০ বছর বয়সে ফল দেয়।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্টার আপেল বীজ থেকে উৎপন্ন চারা ব্যবহার করা হয়। এর বীজে বেশ কয়েক মাস অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা থাকে এবং রোপণের পর দ্রুত (৭-১০ দিন) চারা গজায়। গুটি কলমে ৪-৭ মাসে শিকড় আসে। একই জাতের গাছের বীজ থেকে উৎপাদিত চারার উপর বাডিং বা গ্রাফটিং এর মাধ্যমেও বংশবিস্তার করা যায়। বাডিং বা গ্রাফটিং এর চারা লাগানোর ১-২ বছর পরই গাছে ফল ধরতে শুরু করে। অপরদিকে বীজ থেকে রোপিত গাছ ৫-১০ বছর পর ফল ধরে।

চাষাবাদঃ ভালো নিকাশযুক্ত যে কোন রকম মাটিতে স্টার আপেল গাছ ভালো জন্মায়। ৬-৮ মিটার দূরে দূরে বর্গাকারে বা ষড়ভূজী পদ্ধতিতে অন্যান্য ফল যেমন আম লিচু ইত্যাদির মতো করে গাছ লাগানো যায়। মাঝারি আকারের গাছ বিধায় চারা লাগানোর আগে চারার জায়গায় ৪৫ সেন্টিমিটার (১ হাত) ব্যাসের ৪৫ সেমি. গভীর গর্ত করে তাতে ১ ঝুড়ি পচা আবর্জনা বা পুকুরের তলার সার মাটি, আধা  কেজি টিএসপি বা ১ কেজি ডিএপি অথবা ৩ কেজি হাড়ের গুঁড়া, ২৫০ গ্রাম এমওপি অথবা ২ কেজি চুলার ছাই দিয়ে তা ভালোভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে এবং তার ৭-১০ দিন পর চারা লাগাতে হবে।

সদ্য লাগানো চারা গাছে প্রথম ৬ মাস পর্যন্ত সাপ্তাহিকভাবে নিয়মিত পানি সেচ দিতে হবে। পরবর্তীতে মাটিতে রস না থাকলে সেচ দিতে হয়। তবে গাছে ফুল আসার পর পানি সেচ দিলে ফল ধারন বৃদ্ধি পায়। স্টার আপেল গাছে তেমন সার প্রয়োগ করা হয় না তবে দুর্বল মাটিতে সার প্রয়োগে ফলের আকার ও ফলন বাড়ে।

ফল সংগ্রহঃ শীতের শেষ থেকে গ্রীস্মের প্রথম পর্যন্ত স্টার আপেল এর পাকা ফল সংগ্রহ করা যায়। তবে আমাদের দেশে চৈত্র মাসে (মার্চ-এপ্রিল) সবচেয়ে বেশি পাকা স্টার আপেল পাওয়া যায়। গাছ থেকে পাকা ফল এর রঙ কিছুটা হালকা হয়ে এলে আর ফলত্বক স্পঞ্জ এর মতো বা রাবার বলের মতো নরম হলে ফল সংগ্রহ করা হয়। কাঁচা ফলে আঠা ও কষ্টাভাব থাকে ফলে খাওয়া যায় না। গাছ থেকে সাবধানে পাড়তে হয় কেননা মাটিতে পড়লে নরম ত্বকের এ ফল ফেটে যায় ও বাজারমূল্য কমে যায়।

ফলনঃ একটি প্রাপ্ত বয়স্ক ফলন্ত গাছ থেকে গাছের আকারভেদে প্রতিটি ৫০-১০০ গ্রাম ওজনের ১৫০০-৩০০০টি ফল পাওয়া যেতে পারে যার ওজন ৬০ থেকে ২৫০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। সাধারণভাবে পাকা ফল ২-৩ দিন রাখা গেলেও নিম্ন তাপমাত্রায় এক সপ্তাহ পর্যন্ত এ ফল সংরক্ষণ করা যায়। স্টার আপেল এর বীজ ও খোসা বাদে ভেতরের মাংসল অংশ খাওয়া যায়। পাকা ফলের মাঝ বরাবর ছুরি দিয়ে কেটে চামচ দিয়ে ভেতরের অংশ তুলে খেতে এটা খুবই সুস্বাদু। এর নরম শাঁস থেকে বীজ আলাদা করে ডেজার্ট হিসাবে ও সালাদের সাথে খাওয়া যায়। জ্যামাইকাতে এটাকে বিবাহ উৎসবে খাওয়া হয়। অনেকসময় স্ট্রবেরি ও ক্রীম সহযোগেও স্টার আপেল খাওয়া হয়।

ফলের পুষ্টিগুণঃ এ ফলটি অত্যন্ত পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ। প্রতি ১০০ গ্রাম ফলে প্রোটিন থাকে ০.৭২-২.৩৩ গ্রাম, কার্বোহাইড্রেট ১৪.৬৫ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৭.৪-১৭.৩ মিলি গ্রাম, ফসফরাস ১৫.৯-২২.০ মিলিগ্রাম ও আয়রন ০.৩০-০.৬৮ মিলিগ্রাম।

নানাবিধ ব্যবহারঃ স্টার আপেল গাছের কাঠ থেকে বিভিন্ন ধরনের দামি আসবাবপত্র তৈরি করা যায়। রাবার তৈরিতে এ গাছের নির্যাস ব্যবহার করা হয়। এ গাছের ব্যাপক ওষুধিগুণও রয়েছে। স্টার আপেল এর পাকা ফল খেলে ফুসফুসের প্রদাহ ও নিউমোনিয়া রোগের উপশম হয়। এর ফল ডায়াবেটিস রোগে ব্যবহৃত হয়। ভেনিজুয়েলাতে পাকস্থলী ও অন্ত্রের গোলযোগে কম পাকা ফল খাওয়া হয়। তবে এরূপ কাচা ফল বেশি খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিতে পারে। পানিতে ফুটানো ফলের খোসা, বাকল ও পাতার কষ পেক্টোরাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর ট্যানিন সমৃদ্ধ বাকল উত্তেজক হিসেবে, ডায়রিয়া প্রতিরোধে, আমাশয়ে, রক্তপাত বন্ধে এবং গনোরিয়া রোগের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। কিউবাতে এটা ক্যানসার প্রতিরোধক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

আজকাল প্রায়শই কিছু নার্সারির লোকেরা এ গাছকে আপেল গাছ বলে চালিয়ে দিচ্ছে। যে গাছটিকে আপেল গাছ বলা হচ্ছে, সেটি আপেল নয়, স্টার আপেল ফলের গাছ। এদেশে আপেল হবে না। কারণ আপেল জন্মাতে বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় বরফ পড়তে হয়। স্টার আপেল দেখতেও অনেকটা সবুজ আপেলের মতো। তাই ওকে আপেলের ভাই বলা চলে। এ দেশে আপেল হয় না সত্য তবে স্টার আপেল হয়। গাজীপুরে বিএআরআইয়ের উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রে স্টার আপেলের বয়সী গাছটাতে যেভাবে ডাল ভেঙে ফল ধরেছে, তাতে অবাক না হয়ে পারা যায় না। তা থেকে আশা করা যায় এ দেশে ও ভালো ফল ফলতে পারে।

পাহাড়ি অঞ্চলে স্টার আপেল চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও বসতবাড়িতেও শোভাময় এ গাছটি লাগানো যেতে পারে। সামনে আসছে বর্ষাকাল। দেশের বিভিন্ন নার্সারিতে এ গাছটির চারা পাওয়া যায়। বাগানবাড়ির শোভা বর্ধন ও বৈচিত্র্য আনার জন্য দু’ একটা স্টার আপেল গাছ বাড়ির আঙ্গিনায় লাগানো যেতে পারে।

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

As you found this post useful...

Follow us on social media!

We are sorry that this post was not useful for you!

Let us improve this post!

Please don't forget to share this article

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি। সকল স্বত্ব www.agriculturelearning.com কর্তৃক সংরক্ষিত